খবর প্রকাশিত: ০৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৫, ১১:২১ এএম
জানুয়ারিতে দেশে মোট ৬২১টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০৮ জন নিহত হয়েছেন। এসব দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন ১১০০ জন। নিহতদের মধ্যে ৭২ জন নারী ও ৮৪ শিশু রয়েছে। এর মধ্যে ২৭১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ২৬৪ জন নিহত হয়েছেন, যা মোট নিহতের ৪৩.৪২ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩.৬৩ শতাংশ।
মঙ্গলবার (৪ ফেব্রুয়ারি) সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানায়।
এতে বলা হয়, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ৯টি জাতীয় দৈনিক, ৭টি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া ও নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করে।
জানুয়ারিতে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে ৬২১টি। এর মধ্যে নিহত ৬০৮ জন এবং আহত কমপক্ষে ১১০০ জন। নিহতের মধ্যে নারী ৭২ জন ও শিশু ৮৪টি। ২৭১টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ২৬৪ জন, যা মোট নিহতের ৪৩.৪২ শতাংশ। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার হার ৪৩.৬৩ শতাংশ।
দুর্ঘটনায় ১৪৩ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৩.৫১ শতাংশ। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৭৩ জন অর্থাৎ ১২ শতাংশ। এই সময়ে ৪টি নৌ-দুর্ঘটনায় ৬ জন নিহত, ২ জন আহত হয়েছেন। ২২টি রেল ট্র্যাক দুর্ঘটনায় ২৬ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হয়েছেন।
দুর্ঘটনায় যানবাহনভিত্তিক নিহতের পরিসংখ্যানে দেখা যায়- মোটরসাইকেল চালক ও আরোহী ২৬৪ জন (৪৩.৪২%), বাসের যাত্রী ২৮ জন (৪.৬০%), ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি আরোহী ৩৪ জন (৫.৫৯%), প্রাইভেটকার-মাইক্রোবাস-অ্যাম্বুলেন্স আরোহী ১৯ জন (৩.১২%), থ্রি-হুইলার যাত্রী (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ৯০ জন (১৪.৮০%), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহনের যাত্রী (নসিমন-ভটভটি-মাহিন্দ্র-টমটম) ১৮ জন (২.৯৬%) এবং বাইসাইকেল-রিকশা আরোহী ১২ জন (১.৯৭%) নিহত হয়েছেন।
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ বলছে, দুর্ঘটনাগুলোর মধ্যে ২১৪টি (৩৪.৪৬%) জাতীয় মহাসড়কে, ২৬৫টি (৪২.৬৭%) আঞ্চলিক সড়কে, ৯৬টি (১৫.৪৫%) গ্রামীণ সড়কে এবং ৪২টি (৬.৭৬%) শহরের সড়কে এবং ৪টি (০.৬৪%) অন্যান্য স্থানে সংঘটিত হয়েছে।
দুর্ঘটনাসমূহের ১৩৩টি (২১.৪১%) মুখোমুখি সংঘর্ষ, ২৫৮টি (৪১.৫৪%) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে, ১৪১টি (২২.৭০%) পথচারীকে চাপা/ধাক্কা দেয়া, ৭৫টি (১২.০৭%) যানবাহনের পেছনে আঘাত করা এবং ১৪টি (২.২৫%) অন্যান্য কারণে ঘটেছে।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের মধ্যে- ট্রাক-কাভার্ডভ্যান-পিকআপ-ট্রাক্টর-ট্রলি-লরি-ড্রাম ট্রাক ২৯.৬৬%, যাত্রীবাহী বাস ১৪.৬২%, মাইক্রোবাস-প্রাইভেটকার-অ্যাম্বুলেন্স ৩.৭০%, মোটরসাইকেল ২৮.৭৩%, থ্রি-হুইলার (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা) ১৪.১০%, স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-চান্দের গাড়ি-টমটম-মাহিন্দ্র-বোরাক-লাটাহাম্বা) ৪.৩২%, বাইসাইকেল-রিকশা ১.৬৪% এবং অজ্ঞাত যানবাহন ৩.১৯%।
দুর্ঘটনায় সম্পৃক্ত যানবাহনের সংখ্যা ৯৭১টি। (বাস ১৪২, ট্রাক ১৯১, কাভার্ডভ্যান ২৪, পিকআপ ২৬, ট্রাক্টর ১২, ট্রলি ১৮, লরি ৬, ড্রাম ট্রাক ১১, মাইক্রোবাস ১৯, প্রাইভেটকার ১৫, অ্যাম্বুলেন্স ২, মোটরসাইকেল ২৭৯, থ্রি-হুইলার ১৩৭ (ইজিবাইক-সিএনজি-অটোরিকশা-অটোভ্যান-লেগুনা), স্থানীয়ভাবে তৈরি যানবাহন ৪২ (নসিমন-ভটভটি-আলমসাধু-চান্দের গাড়ি-টমটম-মাহিন্দ্র-বোরাক-লাটাহাম্বা), বাইসাইকেল-রিকশা ১৬ এবং অজ্ঞাত যানবাহন ৩১টি।
সময় বিশ্লেষণে দেখা যায়, দুর্ঘটনাসমূহ ঘটেছে ভোরে ৭.০৮%, সকালে ৩১.০৭%, দুপুরে ১৭.২৩%, বিকালে ১৫.৪৫%, সন্ধ্যায় ৯.৯৮% এবং রাতে ১৯.১৬%।
দুর্ঘটনার বিভাগওয়ারী পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকা বিভাগে দুর্ঘটনা ২৭.৬৯%, প্রাণহানি ২৬.৪৮%, রাজশাহী বিভাগে দুর্ঘটনা ১৪.৮১%, প্রাণহানি ১৭.৪৩%, চট্টগ্রাম বিভাগে দুর্ঘটনা ১৫.৬১%, প্রাণহানি ১৫.৭৮%, খুলনা বিভাগে দুর্ঘটনা ১২.৫৬%, প্রাণহানি ১২.১৭%, বরিশাল বিভাগে দুর্ঘটনা ৫%, প্রাণহানি ৪.৯৩%, সিলেট বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.৭৯%, প্রাণহানি ৬.২৫%, রংপুর বিভাগে দুর্ঘটনা ১৩.৩৬%, প্রাণহানি ১১% এবং ময়মনসিংহ বিভাগে দুর্ঘটনা ৫.১৫%, প্রাণহানি ৫.৯২% ঘটেছে।
ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি ১৭২টি দুর্ঘটনায় ১৬১ জন নিহত হয়েছেন। বরিশাল বিভাগে সবচেয়ে কম ৩১টি দুর্ঘটনায় ৩০ জন নিহত হয়েছেন। একক জেলা হিসেবে ঢাকা জেলায় ৪২টি দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত হয়েছে। সবচেয়ে কম পঞ্চগড় জেলায়। এই জেলায় কয়েকটি দুর্ঘটনা ঘটলেও প্রাণহানি ঘটেনি। রাজধানী ঢাকায় ২৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৩ জন নিহত এবং ৩১ জন আহত হয়েছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, পুলিশ সদস্য ২ জন, বিজিবি সদস্য ২ জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ১ জন শিক্ষকসহ বিভিন্ন স্কুল-কলেজ-মাদরাসার শিক্ষক ৯ জন, সাংবাদিক ৩ জন, চিকিৎসক ২ জন, বিপিএটিসি-এর কর্মকর্তা ১ জন, ডিসি অফিসের কর্মকর্তা ১ জন, কারারক্ষী ১ জন, নৃত্যশিল্পী ১ জন, বিভিন্ন ব্যাংক-বিমা কর্মকর্তা ও কর্মচারী ৮ জন, বিভিন্ন এনজিও কর্মকর্তা-কর্মচারী ১৪ জন, ওষুধ ও বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রয় প্রতিনিধি ২৬ জন, স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যবসায়ী ২৭ জন, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ১৩ জন, ইমাম-মুয়াজ্জিন ৬ জন, সাইকেল মিস্ত্রি ১ জন, টিউবওয়েল মিস্ত্রি ১ জন, ইলেক্ট্রিশিয়ান ১ জন, মেকানিক ২ জন, পোশাক শ্রমিক ৯ জন, নির্মাণ শ্রমিক ৪ জন, রাজমিস্ত্রি ৩ জন, ধানকাটা শ্রমিক ৭ জন, পরিচ্ছন্নতাকর্মী ১ জন, প্রতিবন্ধী ২ জন এবং দেশের বিভিন্ন স্কুল-মাদরাসা ও কলেজের ৭৪ জন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।
১. ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন; ২. বেপরোয়া গতি; ৩. চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা; ৪. বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকা; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল; ৬. তরুণ-যুবদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো; ৭. জনসাধারণের মধ্যে ট্র্যাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা; ৮. দুর্বল ট্র্যাফিক ব্যবস্থাপনা; ৯. বিআরটিএ’র সক্ষমতার ঘাটতি; ১০. গণপরিবহন খাতে চাঁদাবাজি।
১. দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে; ২. চালকদের বেতন-কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে; ৩. বিআরটিএ’র সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে; ৪. পরিবহন মালিক-শ্রমিক, যাত্রী ও পথচারীদের প্রতি ট্র্যাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে; ৫. মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন বন্ধ করে এগুলোর জন্য আলাদা পার্শ্ব রাস্তা (সার্ভিস রোড) তৈরি করতে হবে; ৬. পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে রোড ডিভাইডার নির্মাণ করতে হবে; ৭. গণপরিবহনে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে; ৮. রেল ও নৌ-পথ সংস্কার করে সড়ক পথের ওপর চাপ কমাতে হবে; ৯. টেকসই পরিবহন কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে; ১০. সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ বাধাহীনভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
গত জানুয়ারি মাসে প্রতিদিন গড়ে নিহত হয়েছে ১৯.৬১জন। দেশব্যাপী ঘন কুয়াকার কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। এই গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি এবং চালকদের মোটিভেশনাল প্রশিক্ষণ দরকার। বেপরোয়া যানবাহন এবং পথচারীদের অসচেতনতার কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে। এজন্য সরকারি উদ্যোগে গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জীবনমুখী সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে।
পেশাগত সুযোগ-সুবিধা বিশেষ করে, নিয়োগপত্র, বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট না থাকার কারণে বাস এবং পণ্যবাহী যানবাহনের অধিকাংশ চালক শারীরিক ও মানসিকভাবে অসুস্থ। তারা সবসময় অস্বাভাবিক আচরণ করেন এবং বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালান। ফলে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হন। তাই সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে পরিবহন শ্রমিকদের পেশাগত সুযোগ-সুবিধা এবং সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানসমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।