সেখানে বসবাসরত একটি পরিবার বিবিসিকে এই ভিডিওটি পাঠিয়েছে। হাজারারা প্রধানত শিয়া মুসলিম। মুসলিমদের দুটি ভাগ শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে দীর্ঘদিনের বিরোধ রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই সুন্নিরা হাজারাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে আসছে। আফগানিস্তানে নিপীড়নের ভয়ে, অনেক হাজারা সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
পকিস্তানে আসা আফগানিস্তানের ১৭ বছর বয়সী হাজারা শাকেবা। তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘তালেবানদের অধীনে জীবনকে একটি কারাগারের মতো মনে হয়েছিল। তারা (আপগানিস্তান)আমাদেরকে মুসলিম হিসেবে বিবেচনা করে না। তারা আমাদেরকে কাফের বলত। আমরা কখনই তাদের কাছে নিরাপদ বোধ করিনি।’ শাকেবা পরিবারের সঙ্গে ২০২২ সালের প্রথম দিকে পাকিস্তানে আসেন। শাকেবার বাড়ি আশেপাশেও পুলিশের অভিযান চালছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত পুলিশ তাঁর বাড়িতে যায়নি। শাকেবাসহ তাঁর পরিবার চার দেয়ালে ভিতর লুকিয়ে আছে ভয়ে। গত তিন সপ্তাহ ধরে এভাবে লুকিয়ে আছে তারা। তারা আফগানিস্তানে ফিরে যেতে চাননা। শাকেবা বলেন, ‘আমাদের চেহারা অন্যরকম। আমরা পাকিস্তানি পোশাক পরলেও আমাদের সহজেই চেনা যায়। আমাদেরকে আফগানি, আফগানি বলে চিৎকার করে ডাকে হয়।’ আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়ার বিষয়ে শাকেবা বলেন, ‘এটা সত্যিকারের ভয়ের জন্ম দিয়েছে। আমরা তালেবানদের ভয় পাই। আমাদেরকে আগের মতোই হত্যা করতে পারে।’
হাজাররা জাতিগতভাবে মঙ্গোলিয়ান এবং মধ্য এশিয়ার বংশোদ্ভূত। তাদের চেহারা পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের থেকে আলাদা। শাকেবা বলেছিলেন, তিনি এবং তার পরিবার একাধিক হুমকি পাওয়ার পর আফগানিস্তান থেকে পাকিস্তানে চলে এসেছিলেন। তিনি বলেন, “আমি আমার পরিবারকে বলেছিলাম, আমরা এখানেই (পাকিস্তান) থাকব যতক্ষণ না তারা, আমাদের ফিরে যেতে বাধ্য করবে। এটা হাজারাদের জায়গা যদিও নয়, তবুও এখানে থাকতে হবে এবং আমাদের ভাগ্যের জন্য প্রার্থনা করতে হবে।”
সবশেষে সকেবা বলেন,‘আমরা সত্যিই জানি না কোথায় যেতে হবে বা কি করতে হবে। আমরা সব হারিয়ে ফেলেছি। আমার জীবনের যে স্বপ্নগুলো ছিল সব হারিয়ে গেছে।’
আরেক হাজারা ফিদা আলী বলেন, “অবশ্যই পাকিস্তানে মৌলবাদ আছে, কিন্তু আফগানিস্তান সম্পূর্ণ ভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে।” ফিদা আলী একজন প্রাক্তন শিক্ষক। মাত্র দুই বছর আগে পাকিস্তানে আসেন। তিনি বলেন, ‘দেশে সংখ্যালঘু হিসেবে আমরা এক নম্বর টার্গেটে ছিলাম।’
তিনি আরো জানান, হাজারাদের জন্য আফগানিস্তানে চাকরি বা সুযোগ পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অন্যান্য অনেক আফগানরাও চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়। তবে জাতিগত গোষ্ঠীর কারণে হাজারারা আরো তীব্র চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হয়। পূর্ববর্তী আফগান সরকারের অধীনে, হাজারারা নতুন সুযোগ খুঁজে পেয়েছিল। ২০০৪ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি পায়। অনেকে বেসামরিক সমাজ, সরকার এবং সামরিক বাহিনীতে চাকরি পান।
হাজারারা প্রতিবেশী পাকিস্তানকে নিরাপদ বিকল্প মনে না করলেও, তালেবান আবার ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর, এটাই ছিল একমাত্র বিকল্প পথ। তখন অনেকেই সীমান্তের ওপারে পালিয়ে আসা আফগানদের সঙ্গে যোগ দেন। হাজারা জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যগতভাবে আফগানিস্তানের পার্বত্য মধ্যাঞ্চলে বসবাস করে। জলিলা হায়দার নামে একজন আইনজীবী এবং মানবাধিকার কর্মী বলেন, “হ্যাঁ, হাজারারা পাকিস্তানে নিপীড়নের সম্মুখীন হয়। কিন্তু অনেকে মনে করেন, যদি তারা আফগানিস্তানে ফিরে যায় তাহলে তাদের কসাইখানায় ফিরিয়ে দেওয়া হবে।”
জলিলা হায়দার একজন পাকিস্তানি হাজারা। গত কয়েক সপ্তাহে গ্রেপ্তার হওয়া এবং নির্বাসনের হুমকি পাওয়া অনেক আফগনকে তিনি আইনি সহায়তা দিচ্ছেন। তিনি বলেছেন, অনেক কারণে হাজারা এবং তালেবানদের মধ্যে আস্থার উল্লেখযোগ্য অভাব রয়েছে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত যখন তালেবানরা সর্বশেষ ক্ষমতায় ছিল, তখন হাজারা যোদ্ধারা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে, হাজার হাজার হাজারা তালেবানদের হাতে নিহত হয়েছিল। তালেবানকে ১৯৯৮ সালের আগস্টে মাজার-ই-শরীফ, ২০০১ সালে ইয়াকাওলাং এবং ২০০০ সালের মে মাসে রোবাকে গণহত্যা চালানোর জন্য অভিযুক্ত করেছে হাজারা জাতিগোষ্ঠী। সেখানে যোদ্ধা এবং বেসামরিকদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়নি। সবাইকেই হত্যা করা হয়।
তালেবানের একজন মুখপাত্র এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, ‘এটি সত্য নয় এবং এই মৃত্যুগুলো সশস্ত্র সংঘাতের অংশ। উভয় পক্ষের মানুষই হতাহত হয়েছিল।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে হাজারাদের নির্যাতন ও মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার ঘটনা নথিভুক্ত করা হয়েছে। তবে তালেবান সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। হাজারারাও নিয়মিত তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর লক্ষ্যবস্তু।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তালেবানের মুখপাত্র সুহেল শাহীন বলেছেন,“ শীতকালে এতো বেশি আফগানকে পাকিস্তান থেকে বের করে দেওয়ায় অর্থ, কাবুলের তরুণ ইসলামিক সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা।” তিনি বিবিসিকে বলেন, ‘আমরা হাজারাসহ সকল জাতিসত্তার আফগান শরণার্থীদের তাদের দেশে ফিরে আসার জন্য স্বাগত জানাই। আমরা তাদের আশ্বস্ত করছি, তাদের জীবন, সম্পত্তি এবং সম্মান সুরক্ষিত থাকবে। তারা আফগানিস্তানে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারবে।”
পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার-উল-হক কাকার অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, যারা ঝুঁকিতে আছে তাদের ফেরত পাঠানো হবে না। সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি আরব নিউজকে বলেন, ‘এই ধরনের ব্যক্তিদের তথ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে রয়েছে।’ তবে কীভাবে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তা স্পষ্ট নয় এবং মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসির অনুরোধের সাড়া দেয়নি। কোনো তালিকাও প্রকাশ করা হয়নি। আফগান শরণার্থী বিষয়ক পাকিস্তানের কমিশনার আব্বাস খানও বলেছেন, হাজারাদের ওপর পুলিশের হয়রানির ঘটনা ‘বানোয়াট।’
বিবিসি যাদের সঙ্গে কথা বলেছেন,তারা সবাই ভয় ও হতাশা প্রকাশ করেছে। আফগানিস্তানে সেনাবাহিনী ও সরকারের সঙ্গে কাজ করতেন বাকির। প্রায় দুই বছর আগে পাকিস্তানে এসেছিল সপরিবারে। তিনি বলেছেন, “ফিরে যাওয়া (আফগানিস্তানে) হবে আমার জীবন নিয়ে খেলার মতো।” তিনি আরো বলেন, “আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে পারব না। হয়তো সেখানে মৃত্যু আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেখানে কেউ আমাদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না। আমরা একেবারে হারিয়ে গেছি।”
অত্যন্ত অনিশ্চিত ভবিষ্যত আফগানদের জন্য অপেক্ষা করছে। কেউ কেউ ক্যাম্পেই থেকে যাচ্ছে। অন্যরা আবার জীবন শুরু করার জন্য নিজ দেশে রওনা হয়েছে। লাখ লাখ শরণার্থীকে অনেকটা খালি হাতে আফগানিস্তানে ফিরতে হচ্ছে। এদিকে ইতিমধ্যেই পাকিস্তানজুড়ে চলছে অবধৈ আফগানদের ধরপাকড়। পুলিশ তাদের ধরার জন্য রাস্তায় নেমেছে। পরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে শরণার্থীদের কাগজপত্র। অধিকাংশই আফগানরা এখন নির্বাসনের হুমকির সম্মুখীন।