আরুবা এক সুখী দ্বীপের নাম। আরুবা ক্যারিবীয়ান সাগরে অবস্থিত বত্রিশ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত একটি দ্বীপ। আরুবা দ্বীপটি প্রায় পুরোই সমতল।দ্বীপটির অভ্যন্তরের অংশে কিছু ছোট ছোট পাহাড় রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাতটি হলো হুইবার্গ, ভলকানো থেকে যার উৎপত্তি।যার উচ্চতা মাত্র ১৬৫ মিটার (৫৪১ ফুট)। দ্বীপটির সর্বোচ্চ স্থান হলো জামানোটা পাহাড়, সমুদ্র সমতল হতে যার উচ্চতা মাত্র ১৮৮ মিটার (৬১৭ ফুট)। এখানে কোনো নদী নেই।রাজধানী ওরাঞ্জেস্টাড পশ্চিম এ অবস্থিত। বড় শহর ওরাঞ্জেস্টাড। আরুবা দ্বীপটির পশ্চিম ও দক্ষিণ উপকূলের সাদা ও বালুকাময় সৈকতের জন্য এটি বিখ্যাত। এই সৈকত ও বেলাভূমিগুলোতে সামুদ্রিক ঢেউয়ের তীব্রতা কম, এর জলের রং সবুজাভ নীল।তাই এখানেই পর্যটকদের আনাগোনা বেশি।

 



জনসংখ্যা প্রায় এক লক্ষ বারো হাজার । এটি পূর্বে স্প্যানিশ উপনিবেশ ছিল । ১৩৫ বছর পর ওলন্দাজ বা ডাচরা আরুবার দখল পায়। ১৯৮৬ সালে স্বায়ত্তশাসন মঞ্জুর করা হয়েছিল। সরকার ব্যবস্থা হলো সাংবিধানিক রাজতন্ত্র । দ্বীপে রাণীর শাসন বিদ্যমান আছে ।রাণীর নাম বিয়াট্রিক্স। এই দ্বীপের বেশীরভাগ অধিবাসিগণ খ্রীষ্টান। আর সরকারি ভাষা ওলন্দাজ ও পাপিয়ামেন্টো।



এটি কলাম্বিয়া, প্যারাগুয়ানা উপদ্বীপ, ফ্যালকন রাজ্য ও ভেনেজুয়েলার কাছাকাছি অবস্থিত।ক্যারিবীয়ান অঞ্চলের মধ্যে দেশটিকে সবচেয়ে কম বৃষ্টিপাতের দ্বীপ হিসেবে অভিহিত করা হয়। গড় কম বৃষ্টিপাত হয় মার্চ মাসে আর সবচেয়ে বেশি গড় বৃষ্টিপাত হয় নভেম্বর মাসে। এত শুকনো যে আরুবার মধ্য-অঞ্চলের আছে জলবায়ু শুষ্ক ।ওখানে আছে ক্যাকটাস ছড়ানো স্থলভূমি।এখানে বৃষ্টি হয়না বললেই চলে, তাই এখানে বড় শস্য খামার গড়ে উঠেনি এবং দাসপ্রথার প্রচলন হয়নি। এখানকার জনসংখ্যার প্রায় ৮০% হলো ইউরোপীয়-আদিবাসী শঙ্কর (মেস্টিজো) এবং ২০% হলো অন্যান্য জাতির। মেস্টিজোদের মধ্যে প্রধান হলো আরাওয়াক জাতি। এরা ভাঙা-ভাঙা স্পেনীয় ভাষায় কথা বলে। স্পেনীয়দের তখন তারা আরাওয়াকদের চাষবাস ও পশুপালনের অনুমতি দেয়।।মূলত দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ডাচদের লবণের সরবরাহ রক্ষার জন্য ডাচরা আরুবা দখল করেছিল। এই দ্বীপটিকে ওলন্দাজরা পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য এলাকার জন্য মাংসের উৎস হিসাবে ব্যবহার করতো। ক্যারিবীয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্যান্য দ্বীপের চাইতে আরুবাতে আরাওয়াক ঐতিহ্যের প্রাধান্য বেশি লক্ষ্য করা যায়।



দ্বীপটিতে প্রচুর দর্শনার্থী আসে বছর জুড়ে।বেশীর ভাগ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তারপর ইউরোপ থেকে আসে। আরুবা একটি পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার একটি প্রধান কারণ হল এর জলবায়ু। সরকার পর্যটন অবকাঠামোতেও ভালো বিনিয়োগ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্বমানের হোটেল যা প্রত্যেক দর্শনার্থীর থাকার জন্য আকর্ষনীয় ।তাদের প্রাপ্য ছুটিকে আরামদায়ক ও আনন্দদায়ক করে তোলার জন্য সব ব্যবস্থা করে রেখেছে ।অত্যন্ত পরিচ্ছন্ন ,ছিমছাম।দ্বীপটিতে উবার এখনো চালু হয়নি।ট্যাক্সি,বাস সার্ভিস ,ট্রাম আছে।বাইক আর ইলেক্ট্রিক স্কুটার ভাড়া নিয়ে ঘুরে বেড়ানো যায়। বুকিং দিয়ে দিনভর নানা ওয়াটার এক্টিভিটি করা যায় ।নানা ধরনের নৌকা , বোট, সাবমেরিন ট্রিপের ব্যবস্থা রয়েছে।ফ্লেমিঙ্গো দেখতে যাওয়া যায়।বাটারফ্লাই যারা ভালবাসেন তারা বাটার ফ্লাই ফার্মে যেতে পারেন।

পাম বীচ এলাকার বারসেলো আরুবা আমাদের গন্তব্য ।আমেরিকান এয়ারলাইনসে আরুবার মাটি স্পর্শ করার সময় প্লেনের জানালা দিয়ে যে অপরূপ দৃশ্য দেখলাম তাতে লাভ এট ফার্স্ট সাইট যাকে বলে তাই হলো।দ্বীপটির প্রেমে পড়ে গেলাম।এয়াপোর্টে লাগেজ পিকআপ করে শাটল রেডী ছিলো পিকআপের জন্য ।শাটলের ড্রাইভার খুব জলি মাইন্ডেড।আরুবায় স্বাগতম জানানোর পাশাপশি সে আমাদের আরুবার স্থাপনাগুলো চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ।আরুবায় জন্ম নেয়া শিশুরা চার চারটি ভাষায় দক্ষতার সাথে কথা বলতে পারে ডাচ,স্প্যানিশ,পাপিয়ামেনটো,ইংলিশ।আরুবা নাম্বার ওয়ান পর্যটক বান্ধব।নাম্বার ওয়ান ক্রাইম ফ্রী। সী ফুডের জন্য বিখ্যাত ।আমি আমার মেয়ে আমরা দুজন সাথে কোন পুরুষ মানুষ ছাড়া সুন্দর বেড়ালাম সব জায়গায় ।কোন রকম অশোভন ঈঙ্গিত বা মন্তব্য কেউ করেনি।একবারের জন্যও মনে হয়নি আমরা নিরাপদ নই।কোন ভিক্ষুক দেখিনি।রাস্তাঘাটে কোন নোংরা,ময়লা দেখিনি।বৃষ্টি দেখিনি।

আমরা যে হোটেলে ছিলাম সেটি ছিল অল ইনক্লুসিভ।আমাদের চা,কফি, জুস, ড্রিংক্স তিনবেলার খাবার সব সাজানো ছিলো ।আমরা সময় মত যেয়ে খেয়ে নিয়েছি।এটি পাম বীচ এলাকায় ।এর একপাশে হায়াত রিজেন্সি।অপর পাশে রিউ প্যালেস ।


বারসেলো আরুবা একটি পাঁচ তারকা হোটেল।দুটি রেস্টুরেন্ট, ক্যাসিনো ,পুল, জাকুজি,বলরুম,স্পা, জিমসব সহ রেস্টুরেন্ট রয়েছে পাঁচটা ।সুশী,ইটালীয়ান ,ম্যাক্সিকান, ক্যারিবিয়ান এই রেস্টুরেন্ট এ ডিনার বা লাঞ্চের জন্য বুকিং দিতে হয় আগেই।


তবে দুটো বুফে রাত দশটা পর্যন্ত খাবার সরবরাহ করে।

আমাদের ট্রাভেল এজেন্ট ছিলেন ইউএস বিডির (USBD Travels & Tours ) মশিউর রহমান ।অত্যন্ত ভদ্র এবং নির্ভরযোগ্য। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে ভ্রমণ বেশ জটিল হয়ে পড়েছে। দেশগুলো নানা পরিবর্তন আপডেট করে বিমান যাত্রী বা আন্তর্জাতিক যাত্রী দের জন্য।নানা প্রশ্ন মনে আসে। সারাক্ষণ টেনশন।উনি সব প্রশ্নের উত্তর হাসিমুখে দিয়ে থাকেন।আরুবা ভ্রমনের জন্য প্রাক প্রস্তুতি নিতে কিছু জরুরী কাজ করতে হয়।ইডি কার্ড বা হেলথ কার্ড এর মধ্যে একটি।




আরুবার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ এবং আরামপ্রদ। এখানে তাই সারা বছর ধরেই পর্যটকেরা ভ্রমণে আসে। এখানকার তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে অল্পই বাড়ে বা কমে থাকে।

আমরা যদি দ্বীপের মানচিত্র দেখি তবে আমরা প্রায় মাঝ বরাবর একটি লাইন আঁকতে পারি এবং একে পশ্চিম এবং পূর্বে দুই ভাগে বিভক্ত করতে পারি। দ্বীপের পশ্চিম দিকে দশটি সৈকত রয়েছে এবং পূর্ব দিকে রয়েছে চারটি।এর মধ্যে বিখ্যাত পাম বীচ,ঈগল বীচ,রেনেসাস বীচ, ম্যালমক বীচ,বেবী বীচ, ফ্লেমিঙ্গো বীচ,ন্যাচারাল পুল ও কন্চি উল্লেখযোগ্য ।

ঈগল বীচ হল আরুবার দীর্ঘতম এবং প্রশস্ত, সাদা বালির সৈকত। বিখ্যাত ফোফোটি গাছ যা ঈগল বীচে আপনি খুঁজে পাবেন। সৈকতের বিশাল স্থানের কারণে, এটি অনেক আকর্ষনীয় একটি কেন্দ্র। এর মধ্যে রয়েছে ঈগল সৈকতে কচ্ছপের বাসা এলাকায় একটি নির্দেশিত সফরে যোগ দিতে পারেন।ইস্টার সপ্তাহে সৈকতে ক্যাম্প করতে পারেন।আপনার সৈকত ম্যাট বের করুন, বালির উপর পালাপায়ার নীচে বিছিয়ে নিন এবং আপনার প্রিয় বই পড়ুন।সৈকতে ভলিবল খেলুন।স্ফটিক স্বচ্ছ জলে সাঁতার কাটুন।এখানে জলের রং ফিরোজা । একটি কায়াক বা স্ট্যান্ড-আপ প্যাডেলবোর্ডে চড়ুন। এটা আসলে বিনামূল্যে জনসাধারণের কাছে অ্যাক্সেসযোগ্য সৈকত ।আমরা এই বীচে তিনঘন্টা মনের আনন্দে জলে ভাসলাম।

ম্যালমক বীচ একটি পাথুরে বীচ।এর দীর্ঘ সমুদ্র তট জুড়ে প্রবালের মত কালচে পাথর ।পানি এসে আছড়ে পড়ে ।এখানে নানা আকৃতির নানা রঙের গিরগিটি দেখলাম ঘুরে বেড়াতে ।এখানে পানির রঙ অপেক্ষাকৃত বেশী নীলাভ।মানুষ এখানে ডাইভিং ,স্নোরকেলিং করছিলো ।সার্ফিং
আর প্যারাস্যুটিং ও করছিলো ।

আরুবায় কম পরিচিত গন্তব্যগুলিও আকর্ষণীয় ।যেগুলি আরও জনপ্রিয় (বা হয়তো আরও ভাল) হিসাবে মোহনীয় যার আকর্ষণ রয়েছে যেমন ব্লু লেগুন । ব্লু লেগুনে সাঁতার কাটুন। গুহাটি দেখার পরে, আপনি আরও শীতল হওয়ার জন্য শান্তিপূর্ণ ব্লু লেগুনের দিকে যেতে পারেন। আরুবার শুকনো গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু বিবেচনা করে থামার জন্য ব্লু লেগুন একটি চমৎকার জায়গা।