অধিকৃত কাশ্মীরে পর্যটকদের ওপর হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা এখন চরমে। পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুটি দেশই সীমিত পরিসরে সামরিক হামলার আভাস দিচ্ছে। এতে ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধাবস্থার মধ্যে এশিয়াতেও একই পরিস্থিতি তৈরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তবে কোনোমতেই আরেকটি যুদ্ধ চাইছে না আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায়।
গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন নিহত হন, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয় পর্যটক ছিলেন। এ ঘটনায় পাকিস্তান জড়িত বলে অভিযোগ করেছে চিরবৈরী ভারত। যদিও হামলার সঙ্গে কোনোরকম সংশ্লিষ্টতার দায় অস্বীকার করেছে পাকিস্তান।
এ হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নিয়ন্ত্রণরেখা (লাইন অব কন্ট্রোল) বরাবর সপ্তম দিনের মতো দুই দেশের সেনাদের মধ্যে গোলাবিনিময় হয়েছে। এরই মধ্যে প্রতিবেশী এই দুটি দেশই সীমিত পরিসরে হামলার ইঙ্গিত দিচ্ছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি ও মার্কিন সংবাদ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
এ ছাড়াও পেহেলগামের ভয়াবহ ওই হামলার জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন চুক্তি স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছে উভয় পক্ষ। তাছাড়া, হামলার পরে দুই দেশই ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রতিবেশী দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল করে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
২০১৯ সালে কাশ্মীরে আত্মঘাতী গাড়ি বোমা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সেনা নিহত হওয়ার পর থেকে এবারই দেশ দুটির মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক সব থেকে খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে। তবে দেশ দুটি যে যুদ্ধাংদেহী অবস্থানে রয়েছে; তার ভবিষ্যৎ আসলে কি এই নিয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।
ভারত ও পাকিস্তান বহু বছর ধরেই পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। তবে দুই দেশেরই দাবি তাদের অস্ত্রগুলোর উদ্দেশ্য যুদ্ধ শুরু করা নয়; বরং প্রতিরোধ করা।
এক্ষেত্রে ভারতের নীতি হলো ‘প্রথমে ব্যবহার না করা’। তার মানে, ভারত কেবল তখনই পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে, যখন তাদের সেনাদের ওপর বা ভারতের ভূখণ্ডের ওপর পারমাণবিক হামলা হবে।
অন্যদিকে পাকিস্তানের নীতি হলো ‘ফুল স্পেকট্রাম ডিটারেন্স’ বা সম্পূর্ণ পরিসরে প্রতিরোধ কৌশল। ভারতের মতো বড়, শক্তিশালী ও ধনী আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বীর পারমাণবিক বা গতানুগতিক সামরিক হামলার মোকাবিলায় পাকিস্তানের এই প্রস্তুতি।
তবে প্রথমে ব্যবহার না করার নীতিতে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে পাকিস্তানে। দেশটি মনে করে যে তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে, সেক্ষেত্রে তারা প্রথমে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের শঙ্কা উড়িয়ে দেয়নি।
এপির প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতের তুলনায় কম সামরিক শক্তির কারণে পাকিস্তান বাস্তবিক অর্থে পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করার ক্ষমতা রাখে না বলে ধারণা বিশ্লেষকদের।
তবে এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, ভারত কিংবা পাকিস্তান কোনো দেশই কিন্তু নিশ্চিতভাবে জানে না অপর দেশের কাছে ঠিক কি পরিমাণ বা কী ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে। ১৯৭৪ সালে প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা চালায় ভারত। এদিকে, পাকিস্তান প্রথম পরীক্ষা করে ১৯৮৮ সালে।
বিভিন্ন থিংকট্যাংকের মতে, পাকিস্তানের কাছে প্রায় ১৭০টি পারমাণবিক অস্ত্র আছে, আর ভারতের প্রায় ১৭২টি। অবশ্য কিছু বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের অস্ত্রসংখ্যা আরও বেশি হতে পারে, প্রায় ২০০টি হতে পারে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেশী এই দেশ দুটির মধ্যে বৈরিতা থাকা স্বত্ত্বেও দুই দেশের পারমাণবিক স্থাপনা ও অবকাঠামোগুলোতে হামলা পরিচালনা না করার জন্য তারা ১৯৮৮ সালে একটি চুক্তি করে। ১৯৯১ সালে এ চুক্তি কার্যকর হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, দুই দেশ প্রতি বছর জানুয়ারি মাসে পরস্পরকে তাদের পারমাণবিক স্থাপনার তথ্য সরবরাহ করবে। ১৯৯২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দুই দেশের মধ্যে তথ্য বিনিময়ের প্রথা শুরু হয়। এরপর থেকে তারা টানা ৩৪ বছর ধরে এই তালিকা বিনিময় করেছে।
তবে, ভারত-পাকিস্তান কেউই আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্র সম্প্রসারণ প্রতিরোধ চুক্তিতে সই করেনি। এই চুক্তিটি বিশ্বব্যাপী পারমাণবিক অস্ত্র ও প্রযুক্তির বিস্তার ঠেকানোর উদ্দেশ্যে গঠিত।
ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে প্রায়শই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে। তবে দুই দেশের সেনারাই নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতেই হামলা চালায়। আরেক পক্ষ আবার পাল্টা হামলা করে। এ ধরনের হামলাগুলোর উদ্দেশ্য হলো, প্রতিপক্ষ যেন পিছুহটার সুযোগ পায়, পাশাপাশি উত্তেজনা কমানোর জন্য সময় পাওয়া যায়।
তবে ২২ এপ্রিলের পেহেলগামের ঘটনা ছিল ভিন্ন। নিহত ২৬ জনের মধ্যে বেশিরভাগই ভারতীয় হওয়ায় এই হামলার তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য ভারত সরকারের ওপর অভ্যন্তরীণ চাপ রয়েছে।
এর আগে ২০১৯ সালে আত্মঘাতী গাড়ি বোমা হামলার পর পাকিস্তানের একটি ক্যাম্পে বিমান হামলা চালিয়েছিল ভারত। ভারতের দাবি সেটি ছিল একটি সন্ত্রাসবাদী প্রশিক্ষণ শিবির।
এরপরে দুটি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করে এক পাইলটকে আটক করার দাবি করে পাকিস্তান। পরবর্তীতে সেই পাইলটকে মুক্তি দেওয়া মাধ্যমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করে।
তবে বিশ্লেষকরা জানান, ওই ঘটনা একটি বিষয় নিশ্চিত করেছে, সেটি হলো পাকিস্তানের আকাশসীমায় প্রবেশ করে হামলা চালাতে সক্ষম ভারত।
বর্তমান পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত দুই দেশই তেমন কোনো নাটকীয় পদক্ষেপ নেয়নি। তবে মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) এলওসি বরাবর আকাশসীমা লঙ্ঘন করায় ভারতীয় একটি ড্রোন ভূপাতিত করার দাবি করেছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী। এরপর ভারতীয় রাফায়েলকে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর জেট বিমানের তাড়া করার কথা জানায় দেশটির সামরিক বাহিনী।
বিশ্লেষকের ধারণা, উভয় পক্ষের প্রতিশোধমূলক হামলাগুলো এই এলওসি বরাবরই পরিচালিত হতে পারে। সেখানের বিভিন্ন সেনা ঘাঁটি বা জঙ্গি ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে। তবে এই কৌশলেও ঝুঁকি রয়েছে, কারণ যেকোনো প্রাণহানিই দুইদেশের অভ্যন্তরীণ অসন্তোষ আরও উসকে দিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
মধ্যপ্রাচ্য ও ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় আরেকটি যুদ্ধ চাইছে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, তিনি ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করবেন। একই সঙ্গে অন্যান্য বিদেশি শক্তিগুলোকেও হস্তক্ষেপ করে চলমান পরিস্থিতি শান্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
এ ছাড়াও ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে চলমান উত্তেজনা নিরসনে দুই দেশকে সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছে মিত্র দেশ সৌদি আরব ও ইরান। যে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াতে দেশ দুটির মধ্যে মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দিয়েছে তারা। দুই দেশের আরেক শক্তিশালী প্রতিবেশী চীনও তাদের সংযত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
এছাড়া দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার এই উত্তেজনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘও। সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনে তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। বলতে গেলে, কেউই আরকেটি যুদ্ধই চাইছে না।