আর্ন্তজাতিক ডেস্ক: গোটাবায়া রাজাপাকসেকে তাড়া করে ভাগিয়েছে শ্রীলংকা। ‘গোটা’ নামে দেশে সমধিক পরিচিত প্রেসিডেন্ট সদ্যই বিদেশে পালিয়েছেন। করেছেন পদত্যাগও। আর এতদিন ধরে প্রতিবাদে মুখর বিক্ষোভকারীরা পেয়েছে জয়ের আনন্দ। কিন্তু এখন তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে এক কঠিন অধ্যায়। রাজাপাকসের বিদায়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে লড়ে যাওয়া আর খুব কঠিন কিছু সিদ্ধান্ত তাদেরকে নিতে হবে এখনই।
রাজাপাকসের শাসনাবসানে শ্রীলংকার বিক্ষোভকারীদের দৃষ্টি এখন রনিল বিক্রমাসিংহের দিকে। যিনি একসময় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, কিন্তু তিনিও ছিলেন ভীষণভাবে অজনপ্রিয়। প্রায় দুই দশক ধরে শ্রীলংকা শাসন করা প্রভাবশালী রাজাপাকসে পরিবারের প্রভাবমুক্ত নন এই রনিল বিক্রমাসিংহে। বরং উল্টো রাজাপাকসেদের সঙ্গেই তার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ।
বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়া রনিল বিক্রমাসিংহের বৈধতা জনগণের দৃষ্টিতে তেমর নেই। অতীতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারে বিক্রমাসিঙহে তেমন সুবিধা করতে পারেননি। ২০২০ সালে নিজ আসনেই তিনি নির্বাচনে হেরেছেন। বর্তমানে শ্রীলংকার বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে তিনি প্রেসিডেন্টের শীর্ষ পদটিতে আসীন হয়েছেন। গোটাবায়া রাজাপাকসে তড়িঘড়ি দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় বিক্রমাসিংহেকে তত্ত্বাবধায়ক নেতার পদে বসিয়ে গেছেন। গত বুধবার শ্রীলংকার হাজারো বিক্ষোভকারী ‘গোটা গো হোম’ ধ্বনিতে বিক্ষোভ করার পাশাপাশি বিক্রমাসিংহের সরে যাওয়ার দাবিতেও বিক্ষোভ করেছে। তারা সে সময়কার প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহের দপ্তরও তছনছ করেছে।
কিন্তু তবুও আগামী বুধবার নতুন একটি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত বিক্রমাসিংহেই ক্ষমতায় থাকবেন। তিনি অবশ্য সাংবিধানিক প্রক্রিয়া মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে অনেকেই মনে করেন তিনি হয়ত নির্বাচনে জেতার চেষ্টা নেবেন এবং সম্ভবত রাজাপাকসের ক্ষমতাসীন শ্রীলংকা পিপলস ফ্রন্ট পার্টির (এসএলপিপি) সমর্থন জিতেও নেবেন।
শ্রীলংকার ছয়বারের প্রধানমন্ত্রী বিক্রমাসিংহে কখনও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেননি। দুর্নীতি আর কলঙ্কয় তার শাসনামল কালিমালিপ্ত। তবে তার দেশ চালানোর অভিজ্ঞতা আছে। তাই এ মুর্হর্তে দেশে স্থিতিশীলতা ফেরানো এবং সরকার পরিচলনা নিরবিচ্ছিন্ন রাখতে চান যেসব এমপি’রা তাদের অনেকেই বিক্রমাসিংহকে সমর্থন করছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
প্রেসিডেন্ট পদের জন্য প্রার্থী আছেন বিরোধীদলীয় নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা এবং সাবেক সাংবাদিক দুল্লাস আলাহাপেরুমা । অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত হলেও ক্ষমতাসীন এসএলপিপির জ্যেষ্ঠ আইনপ্রণেতা দুল্লাস একজন সম্ভাবনাময় প্রার্থী। কিন্তু প্রেসিডেন্ট পদে লড়াইয়ের দৌড়ে এই দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোট ভাগ হয়ে যেতে পারে। আর তাতে বিক্রমাসিংহে লাভবান হয়ে যেতে পারেন-এমন সম্ভাবনা আছে।
কিন্তু ঘড়ির কাঁটা চলছে আপন গতিতে। শ্রীলংকাবাসীর সামনে ঝুলছে সেন্ট্রাল ব্যাংকের গভর্নরের সেই সতর্কবার্তা। দ্রুত স্থিতিশীল সরকার না হলে দেশ থমকে যাওয়া এবং এ মাসের শেষে জ্বালানি কেনার জন্য যথেষ্ট বিদেশি মুদ্রা থাকবে কিনা তা নিয়ে অনিশ্চয়তার বার্তা বিবিসি-তে দেয় সেন্ট্রাল ব্যাংক। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে হলে দেশের খুব জলদি একজন নেতা দরকার, যিনি অতিপ্রয়োজনীয় বেইলআউট প্যাকেজ নিয়ে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে আলোচনা চালাতে পারবেন।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিক্ষোভকারীরা কি এই অর্থনৈতিক ধাক্কা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আপাতত আপোস করবে এবং বিক্রমাসিংহেকে মেনে নেবে? বিবিসি গত সপ্তাহে এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে প্রত্যেকের কাছ থেকেই ‘না’ জবাব পেয়েছে। কারণ, বিক্রমাসিংহের দুর্নাম এতটাই বেশি যে, শ্রীলংকাবাসী তাঁর বদলে অন্য আর যে কাউকেই মেনে নিতে রাজি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের কথায়, “তিনি সবাইকে, এমনকী রাজাপাকসেকেও জবাবদিহিতা করানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন, কিন্তু কিছুই করেননি। মানুষজন আবার তাকে বিশ্বাস করবে- এমন চিন্তা করা অবান্তর।” শনিবার বিক্ষোভের এক আয়োজক নুজলি হামীন পার্লামেন্ট সদস্যদেরকে জনগণের কথা শোনা এবং বিক্রমাসিংহেকে প্রেসিডেন্ট পদে না বসানোর আহ্বান জানিয়েছেন। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেছেন, “আপনারা বিক্রমাসিংহেকে সমর্থন দিলে আগামী নির্বাচনে জনগণ আপনাদেরকে সমর্থন দেবে না। সেটি আপনাদের মনে রাখা উচিত।”
বিক্ষোভের আয়োজকরা আগামী বুধবার বিক্রমাসিংহে জয়ী হলে বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এখন বিক্রমাসিংহে কেবল অর্থনৈতিক সংকট সমাধান করা কিংবা অন্তত জ্বালানি সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে পারলেই বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে পারতে পারেন। কিন্তু সেটি তো রাতারাতি হওয়া সম্ভব নয়। গত সপ্তাহে এক বৈঠকে আয়োজকদেরকে এক আইনপ্রণেতা বলেন, “আগামীতে যে-ই ক্ষমতায় আসুক আরাগালেয়া কে তাকেই মেনে নিতে হবে। কারণ, বিক্ষোভ তো চলতে পারে না।” কিন্তু এখন আরও গুরুতর প্রশ্ন হচ্ছে, বিক্ষোভ চলতে থাকাটা যুক্তিযুক্ত কিনা? গত কয়েকমাসে বিক্ষোভে জনগণের শক্তির স্ফুরণ দেখা গেলেও এখন কয়েকটি দিক থেকে বিক্ষোভ নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়েছে।
শ্রীলঙ্কার বার অ্যাসোসিয়েশন গত সপ্তাহেই বিক্ষোভকারীদেরকে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে সরে যাওয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেছিল, তারা আইন শৃঙ্খলাহীন পরিস্থিতি মেনে নেবে না।” অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসও বিশৃঙ্খলার মধ্যে তাদের ওপর হামলা হওয়া নিয়ে অভিযোগ করেছে।
আগে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে কিছু কিছু ব্যবসায়ীও তাদেরকে প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়েছে। কিন্তু বিক্ষোভ দীর্র্ঘস্থায়ী হলে এবং দেশ অস্থিতিশীল থাকলে এই ব্যবসায়ীরাই তখন বিক্ষোভকারীদের দিকে হাত বাড়াতে আরেকবার ভাববে। তাছাড়া, সম্প্রতি কয়েকমাসে বিক্ষোভকারীদের তাণ্ডব আর নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে কিছু ক্ষয়ক্ষতির পর বিক্ষোভের আয়োজকরাও এখন মারমুখী অবস্থান থেকে সরে এসে কেবল শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের দিকেই মনোনিবেশ করতে চাইছে।
বিক্ষোভের আয়োজক ফাদার জীবন্থ পিরিস বলেন, “মানুষজন মরিয়া… তারা অস্থিরতার মধ্যে আছে। রনিল এর জন্য সরাসরি দায়ী।” তবে পিরিস বলেন, তারা পদযাত্রা এবং ধর্মঘটের মতো অহিংস বিক্ষোভই করতে চান। মানুষের জানমালের কোনও ক্ষতি হোক, কেউ আহত হোক তা চান না। কিন্তু আগামী দিনগুলোতে শ্রীলংকানদের জন্য যত কঠিন সিদ্ধান্তই অপেক্ষা করে থাকুক না কেন সেটি কোনও ব্যাপার না। কারণ, তারা এরই মধ্যে অনেককিছু অর্জন করে ফেলেছে। কয়েকমাসের বিক্ষোভে শ্রীলংকায় একই দাবিতে সোচ্চার হয়ে একতাবদ্ধ হয়েছে তিনটি প্রধান সম্প্রদায়- সিংহলী, তামিল এবং মুসলিম। নারী, পুরুষ, বৌদ্ধ ভিক্ষু, খ্রিস্টান যাজক, নান এবং মুসলিম ব্যবসায়ীরা সবাই হাতে হাত মিলিয়েছে।
বিক্ষোভকারী নেতা ভিসাকা জয়বীরার কথায়, “আমাদের তরুণ প্রজন্মকে আমরা মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যেতে শেখাইনি। তারা সামনে এগিয়ে যাবে। তাদের প্রত্যেকটি দাবির জন্য সোচ্চার হবে।” রাজাপাকসেদের এতবছরের দাসত্ববন্ধনে থেকেও শ্রীলংকাবাসী দেশকে এই পরিবারের লৌহমুষ্ঠি থেকে বের করে আনার অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেছে। দেশ কিভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত তা নিয়ে ব্যাপক পরিসরে জনগণের কথা বলার দাবিতে সাধারণ মানুষ কীভাবে সাহস নিয়ে সামনে এগিয়েছে- তার সাক্ষী হিসাবে এই ক্ষণ হয়ত ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাই শ্রীলংকার রাজনতিবিদরাও এখন জানেন যে, তারা ঠিকমত দেশের জন্য কাজ না করলে ভবিষ্যতে তাদের জন্য কী অপেক্ষা করে আছে।