বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়ন কেন্দ্রিক দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়ন মডেলের উচ্চ প্রশংসা করেছেন বিশেষজ্ঞ ও কূটনীতিকরা। তারা বলেন, দারিদ্র্য দূরীকরণ ও সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন ও জেন্ডার সমতা কেন্দ্রিক যেসব মডেল বাংলাদেশে উদ্ভাবিত হয়েছে, কার্যকারিতার কারণে তা উচ্চ প্রশংসার দাবি রাখে।
বুধবার (১৩ জুলাই) জাতিসংঘের উচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক ফোরাম চলাকালীন এর বাইরে আয়োজিত এক অনলাইন আলোচনা সভায় তারা এসব পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। 'দক্ষিণের দেশগুলোতে উন্নয়ন কার্যক্রম থেকে আহরিত শিক্ষা : ব্র্যাকের ৫০ বছর' শীর্ষক এই আলোচনার যৌথ আয়োজন করেছে ব্র্যাক, জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন এবং জাতিসংঘে রোয়ান্ডা প্রজাতন্ত্রের স্থায়ী মিশন।
বক্তারা বলেন, একটি দেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি নির্ধারণে পরস্পর সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ের নিয়ামক ভূমিকা থাকে। দেশের কার্যকর প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে অর্থপূর্ণ অংশীদারত্ব থাকা অত্যাবশ্যক। টেকসই দারিদ্র্য বিমোচন এবং দারিদ্র্যের বহুমাত্রিক সমস্যা নিরসনে প্রয়োজন এমন সমাধান যা ব্যয়সাশ্রয়ী, সহজে প্রসারযোগ্য এবং সহজ।
আলোচনায় বক্তব্য রাখেন জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা, জাতিসংঘে রোয়ান্ডা প্রজাতন্ত্রের স্থায়ী উপ-প্রতিনিধি রবার্ট কাইনামুরা, ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্, লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস-এর অধ্যাপক ওরিয়ানা ব্যান্ডিয়েরা, জাতিসংঘের ওএইচআরএলএলএস-এর সিনিয়র প্রোগ্রাম অফিসার সুজানা উলফ এবং ব্র্যাক ইউএসএ-এর মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা ডোনেলা র্যাপিয়ার। অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনায় ছিলেন ইন্টার প্রেস সার্ভিসেসের (আইপিএস) সিনিয়র ভাইস চেয়ার ফারহানা হক রহমান।
অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূত রাবাব ফাতিমা তার বক্তব্যে বলেন, 'একটি দেশকে টেকসই ও স্থায়ীভাবে উন্নয়নের পথরেখায় স্থাপন করতে হলে চাই আঞ্চলিক, বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ের অর্থপূর্ণ অংশীদারত্ব। গত ৫০ বছর ধরে ব্র্যাক ঠিক এই কাজটিই করে এসেছে। বহু সফল মডেল তারা উপস্থাপন করেছে এবং এসব মডেল উদ্ভাবন ও প্রয়োগে সরকারগুলো, জাতিসংঘ, বহুপাক্ষিক প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় সহযোগীদের সঙ্গে কার্যকর অংশীদারত্ব গড়ে তুলেছে। এসব অংশীদারত্বের মধ্য দিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে ব্র্যাক। এসব শিক্ষা দক্ষিণের দেশগুলোয় স্থানীয় সমাধান প্রয়োগের দ্বারা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে কাজে লাগানো যেতে পারে।'
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ অনুষ্ঠানে বলেন, ক্ষুদ্র পর্যায়ে উন্নয়ন কার্যক্রম নিয়ে কাজ করা অন্যান্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে ব্র্যাকের তফাৎ হচ্ছে ব্র্যাক মূলত একটি 'সল্যুশন ইকোসিস্টেম' বা 'সমাধানমূলক ব্যবস্থাপনা' প্রতিষ্ঠান। 'সামাজিক পরিবর্তন ঘটানো গুরুত্বপূর্ণ এবং এজন্য সরকারের সহযোগী হওয়া জরুরি। সরকারের সহযোগী হয়ে উঠতে না পারলে ব্যবস্থাগত পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়, তিনি বলেন।
এলএসই অধ্যাপক ওরিয়ানা ব্যান্ডিয়েরা তার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বলেন, গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচকে আপাতদৃষ্টিতে ব্যয়বহুল একটি মডেল বলে মনে হতে পারে। কিন্তু কার্যত এটি ব্যয়বহুল নয় কারণ এতে খরচ পুনরাবৃত্তি হয় না, একবারই খরচ হয়।
তাছাড়া একে আমাদের ব্যয় নয়, মানব উন্নয়নে বিনিয়োগ হিসেবে দেখতে হবে। এই বিনিয়োগে লাভ হয় অত্যন্ত উচ্চমাত্রায়, কেননা যেসব নারী এই প্রক্রিয়ায় অতিদারিদ্র্য থেকে বেরিয়ে আসেন তারা নিজ নিজ গ্রামের অর্থনীতিতে অবদান রাখেন। বস্তুত আমরা সাধারণত শিখে থাকি দারিদ্র্য নিরসনের জন্য প্রয়োজন প্রবৃদ্ধি; কিন্তু ব্র্যাক প্রমাণ করেছে দারিদ্র্য নিরসনের বাইপ্রোডাক্ট বা ফল হিসেবে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়। আর সেই প্রবৃদ্ধি অর্জন শুরু হয় দেশের সবচেয়ে দরিদ্র এলাকার দরিদ্রতম নারীদের থেকে। গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ এই নারীদের সেই সামর্থ্য অর্জনে সহায়তা করে যার মাধ্যমে নিজস্ব উপায় খাটিয়ে দারিদ্র্য জয়ের লক্ষ্যে এগিয়ে যান তারা, বলেন অধ্যাপক ব্যান্ডিয়েরা।
জাতিসংঘে রোয়ান্ডার স্থায়ী উপ-প্রতিনিধি রবার্ট কাইনামুরা বলেন, ব্র্যাকের মতো গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে তার দেশ ইতিবাচক আর্থসামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। ব্র্যাকের উন্নয়ন অগ্রাধিকারের কৌশল আমাদের দেশের অগ্রাধিকার ও প্রয়োজনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। বিশেষ করে রোয়ান্ডার নারী উন্নয়নে ব্র্যাক গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। মাত্র দশ বছরে সংস্থাটি আমাদের দেশের ১০ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণে সহায়তা করেছে।