যাঁরা সত্যিকারের ব্যবসায়ী তাঁরাও ব্যবসার কাজের জন্য ডলার কিনতে পারছেন না। ব্যাংক এলসি খুলতে হিমশিম খাচ্ছে। ফলে পুরো অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এটি এখন সামাল দিতে হচ্ছে বর্তমান সরকারকে।
এ বিষয়ে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গত ১৫ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে বিদ্যুৎ খাতে সবচেয়ে বড় দুর্নীতি হয়েছে। বিশেষ আইনের কারণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা হয়নি। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিচার হতে হবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা জানান, রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো একাধিকবার সরকারের কাছে বিক্রি করেছেন মালিকরা। সেই সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে গুটিকয়েক কম্পানি।
জানা গেছে, ২০০৮-০৯ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের মধ্যে ১৪ বছরে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল ও আইপিপি (ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) কেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেওয়া হয়েছে ৮৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। গত জুলাইয়ে পরিকল্পনা কমিশনের পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, ১৪ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে সরকার ৯০ হাজার কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। পিডিবির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের হিসাব যোগ করলে তা এক লাখ কোটি টাকার বেশি হবে, যা পুরোটাই পাচার হয়েছে।
পিডিবির তথ্য বলছে, ২০০৮-০৯ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জের পরিমাণ ছিল এক হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। এই অঙ্ক ২০১২-১৩ থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার মধ্যে ছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছর তা বেড়ে দাঁড়ায় পৌনে ৯ হাজার টাকা। এটি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এক লাফে ২৫ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পায়। ওই বছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে ১৭ হাজার ১৫৫ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। অথচ এ সময় বেসরকারি তথা রেন্টাল ও আইপিপি কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতার ব্যবহার কমেছে। পরের দুই অর্থবছরে প্রায় একই পরিমাণ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে বলে জানা গেছে। যা সবই ডলারে পরিশোধিত হয়েছে। এটিই ডলারসংকট উসকে দেয়।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, ওই সময়ে সাবেক সরকারের ঘনিষ্ঠ সামিট গ্রুপকে ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেওয়া হয় প্রায় ১০ হাজার ৬২৩ কোটি টাকা, যা মোট ব্যয়ের প্রায় ১২ শতাংশ। বলা হয় যে সামিটের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। জয়ের প্রশ্রয় পেয়েই বিদ্যুৎ খাতের ‘ডন’ হয়ে ওঠে সামিট গ্রুপ।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক কম্পানি অ্যাগ্রিকো ইন্টারন্যাশনাল ক্যাপাসিটি চার্জ নিয়েছে সাত হাজার ৯৩২ কোটি টাকা। এটির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি। অ্যাগ্রিকোর লুটের টাকার বড় অংশই ববি ভাগ পেতেন বলে জানা যায়। কম্পানিটির বাংলাদেশে ছায়া এজেন্ট ছিলেন এস আলম।
চীনা কম্পানি এরদা পাওয়ার হোল্ডিংস নিয়েছে সাত হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এর বাংলাদেশে অঘোষিত এজেন্ট ছিলেন আবুল কালাম আজাদ। দেশি কম্পানি ইউনাইটেড পাওয়ার হোল্ডিংস নিয়েছে ছয় হাজার ৫৭৫ কোটি টাকা। রুরাল পাওয়ার কম্পানি লিমিটেডকে (আরপিসিএল) নিয়েছে পাঁচ হাজার ১১৭ কোটি টাকা। মে বাংলা ক্যাট গ্রুপ নিয়েছে পাঁচ হাজার ৬৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ বিনিয়োগে গড়ে ওঠা পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েছে চার হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অপর একটি গ্রুপকে চার হাজার ৫২৫ কোটি টাকা এবং খুলনা পাওয়ার কম্পানিকে (কেপিসিএল) চার হাজার ৫৪ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে।
পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত এই কম্পানির ৩৫ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা সামিট গ্রুপের। আর ৩৫ শতাংশ ইউনাইটেড গ্রুপের। বাকি ৩০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের। ফলে এটির ক্যাপাসিটি চার্জের বড় অংশই গেছে সামিট ও ইউনাইটেডের পকেটে।
ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে দেশীয় কম্পানি হোসাফ গ্রুপ দুই হাজার ৬৯৯ কোটি টাকা, মোহাম্মদী গ্রুপ দুই হাজার ৫৪৪ কোটি, ডরিন গ্রুপ দুই হাজার ১৮৩ কোটি ও ম্যাক্স গ্রুপ দুই হাজার ১৫৪ কোটি টাকা নিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের এপিআর এনার্জি দুই হাজার ৮৭ কোটি এবং সিঙ্গাপুরের সেম্বকর্প দুই হাজার ৫৭ কোটি টাকা নিয়েছে।
শাহজিবাজার বিদ্যুৎকেন্দ্র এক হাজার ৯৬৮ কোটি টাকা, সিকদার গ্রুপ এক হাজার ৮৪২ কোটি, কনফিডেন্স গ্রুপ এক হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নিউ ইংল্যান্ড পাওয়ার কম্পানি এনইপিসি কনসোর্টিয়ামের হরিপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র এক হাজার ৫২৮ কোটি টাকা পেয়েছে।
শ্রীলঙ্কান কম্পানি লক্ষধনভি অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস এক হাজার ৪০১ কোটি টাকা, সিনহা গ্রুপ এক হাজার ৩৯১ কোটি, আনলিমা গ্রুপ এক হাজার ২৭৪ কোটি, বারাকা গ্রুপ এক হাজার ২৪৭ কোটি, রিজেন্ট গ্রুপ এক হাজার ৩৭ কোটি এবং এনার্জিপ্যাক এক হাজার ২৭ কোটি টাকা নিয়েছে। এই তালিকায় আরো কিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে, যাদের ক্যাপাসিটি চার্জ আদায়ের পরিমাণ এক হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি।
ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করতে গিয়ে গত ৯ বছরে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হয়েছে প্রায় ১১ হাজার ১৫ কোটি টাকা। দেশটি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হয় ২০১৩-১৪ অর্থবছর। সে বছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল প্রায় ৫০১ কোটি টাকা। ২০১৪-১৫ অর্থবছর আমদানি বাড়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ বেড়ে দাঁড়ায় ৯২২ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছর কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৮৪০ কোটি টাকা। তবে ২০১৬-১৭ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৬৮ কোটি টাকা। ২০১৭-১৮ অর্থবছর বিদ্যুৎ আমদানি কিছুটা বাড়ে, সঙ্গে ক্যাপাসিটি চার্জও। ওই অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয় এক হাজার ৭৮ কোটি টাকা। ২০১৮-১৯ অর্থবছর ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি আরো বৃদ্ধিতে চুক্তি হয়। এতে ক্যাপাসিটি চার্জ এক লাফে বেড়ে দাঁড়ায় এক হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর ক্যাপাসিটি চার্জ ছিল এক হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা, ২০২০-২১ অর্থবছর এক হাজার ৮০৫ কোটি এবং ২০২১-২২ অর্থবছর এক হাজার ৭২৪ কোটি টাকা। আর ২০২১-২২, ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছর মিলে আমদানির বিপরীতে চার হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে।
শুরুতে তিন বছর মেয়াদে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হলেও দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে মেয়াদ। আবার একই কেন্দ্র সরকারের কাছে একাধিকবার বিক্রিরও অভিযোগ রয়েছে। সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণ ব্যয় শোধ করে দিলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটা ওই কম্পানিরই রয়ে যায়। পরে মেয়াদ বাড়ানো হলেও একই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে ফের নির্মাণ ব্যয় পরিশোধ করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের মাধ্যমে লুটপাট করা হয়েছে। কুইক রেন্টালের লাইন্সেস পেয়ে যারা ব্যাংক ঋণ নিয়েছে, তারা প্রায় সবাই ঋণ খেলাপি। বিদ্যুৎ খাতে দুর্নীতির চক্রে পড়ে এভাবেই দেশের অর্থনীতির ভিত দুর্বল করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।