বিদেশি শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য নতুন করে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত মে মাসেই ট্রাম্প প্রশাসন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়, যা অনেকের মতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শামিল। যদিও আদালতের রায়ে এ সিদ্ধান্ত সাময়িকভাবে স্থগিত রয়েছে। তবে ট্রাম্পের পররাষ্ট্র দপ্তর নতুন করে বিস্তৃত পরিসরে নতুন বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসা সাক্ষাৎকার স্থগিত করেছে, যা দেশটির উচ্চশিক্ষা খাতের জন্য বড় ধাক্কা।
এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থিক শঙ্কা আরও বেড়েছে। এমনিতেই গত কয়েক বছরে দেশটির উচ্চশিক্ষা খাতে আগ্রহ কমে গেছে। ২০১৬ সালে যেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ উচ্চবিদ্যালয়-স্নাতক সরাসরি কলেজে ভর্তি হতো, সেখানে ২০২২ সালে তা নেমে এসেছে মাত্র ৬২ শতাংশে। গত ডিসেম্বরে রেটিং সংস্থা মুডিজ জানায়, দেশটির এক-তৃতীয়াংশ প্রাইভেট ও এক পঞ্চমাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বর্তমানে লোকসানে চলছে।
অদূর ভবিষ্যতে আরও বড় সংকট অপেক্ষা করছে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চবিদ্যালয় স্নাতকের সংখ্যা ৬ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ১৩ শতাংশ কমে যেতে পারে। এই হ্রাস সব অঞ্চলে সমান হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-পূর্ব ও মধ্য-পশ্চিমাঞ্চলে, যেখানে ঐতিহাসিকভাবে অনেক বেশি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যা এক-তৃতীয়াংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে বিদেশি শিক্ষার্থীরা পুরো সংকটের সমাধান না হলেও কিছুটা ভারসাম্য তৈরি করছেন। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০ লাখ বিদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন- ২০০০ সালের তুলনায় এই সংখ্যা দ্বিগুণ। এসব শিক্ষার্থী স্থানীয়দের তুলনায় অনেক বেশি ফি প্রদান করেন, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে, যেখানে তাদের ফি প্রায় তিনগুণ পর্যন্ত হয়। অধিকাংশ বিদেশি শিক্ষার্থীই স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পড়েন, যেখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তুলনামূলকভাবে বেশি আয় করে।
তবে এত কিছুর পরও, যুক্তরাষ্ট্রে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা উচ্চশিক্ষার মোট শিক্ষার্থীদের মাত্র ৬ শতাংশ। অন্যদিকে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় এই হার ২৫ শতাংশের বেশি। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতির উন্নতির কোনো লক্ষণ নেই। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শুধু সাময়িক নয়, যুক্তরাষ্ট্রে দীর্ঘমেয়াদে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হ্রাস পাবে, কারণ তারা এখন থেকে অন্য দেশগুলোকে বেছে নেবে।
প্রশ্ন হলো- এই সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে কারা? হার্ভার্ড বা কলাম্বিয়ার মতো অতি-অভিজাত প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশ বড় অংশ বিদেশি শিক্ষার্থী হলেও তারা তুলনামূলকভাবে নিরাপদ। হার্ভার্ডের মোট আয়ের মাত্র ২০ শতাংশ আসে শিক্ষার্থীদের ফি ও আবাসন ব্যয় থেকে, যেখানে অনেক অখ্যাত প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য এই অনুপাত ৮০ শতাংশেরও বেশি। এছাড়া, নামকরা এসব প্রতিষ্ঠানে দেশীয় শিক্ষার্থীদের চাহিদা এত বেশি যে, এসব শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনে আরও বেশি ফি আদায় করতে পারে।
দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, বিপদে পড়বে মূলত দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, যারা রাজ্য সরকারের অনুদান হ্রাসের পর বিদেশি শিক্ষার্থীদের ফি থেকেই নিজেদের ব্যয় মেটাচ্ছিল। উচ্চপর্যায়ের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্য থেকে উচ্চ ফি প্রদানকারী শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করতে পারলেও, কম পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে শিক্ষার্থী আনতে বিপুল অর্থ খরচ করে এজেন্ট নিয়োগ করতে হয়েছে।
বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা হঠাৎ কমে গেলে, এমন সব প্রতিষ্ঠানও ক্ষতিগ্রস্ত হবে যারা কখনো বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করেনি। কারণ, বড় প্রতিষ্ঠানগুলো তখন দেশি শিক্ষার্থীদের ভর্তি বাড়িয়ে দেবে, ফলে নিচু স্তরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য শিক্ষার্থী পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
যুক্তরাজ্যে ভিসা নীতির পরিবর্তনের কারণে সম্প্রতি বিদেশি শিক্ষার্থীর আগমন হঠাৎ কমে গেছে। গত বছর সেখানকার ৪০ শতাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই বাজেট ঘাটতির পূর্বাভাস দিয়েছে।
এই ধস হয়তো কিছু দুর্বল ও অনাকর্ষণীয় প্রতিষ্ঠানকে বন্ধ করে দেবে, যা বড় কোনো সমস্যা নয়। কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হলো, এর ফলে কিছু অঞ্চলে ‘উচ্চশিক্ষা শূন্যতা’ তৈরি হতে পারে, যেখানে শিক্ষার্থীরা সহজে সাশ্রয়ী মূল্যে কলেজে ভর্তি হতে পারবে না। অথবা এই পরিস্থিতি সেইসব প্রতিষ্ঠানের জন্য সুবিধাজনক হয়ে উঠতে পারে যারা কেবল অতীত ঐতিহ্য দিয়ে টিকে আছে, কিন্তু শিক্ষার মানে পিছিয়ে রয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চশিক্ষা বিরোধী অবস্থান কেবল এলিট বিশ্ববিদ্যালয় নয়, গোটা মার্কিন শিক্ষাব্যবস্থাকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে- এমনটাই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকরা।