বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ও পরিবেশগত পরিবর্তন পৃথিবীর প্রতিটা দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। শহরগুলো একটা সাসটেইনেবল বা টেকসই ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করতে গিয়ে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। তবে কিছু শহর ইতিমধ্যে দীর্ঘস্থায়ী ও উচ্চমানের জীবনযাত্রার কথা মাথায় রেখে ‘স্মার্ট সমাধান’ খুঁজে নিয়ে তা বাস্তবায়িতও করেছে, যা পৃথিবীর অন্যান্য শহরের জন্য একটা অনুসরণ করার মতো বিষয়। বিশ্বের সবচেয়ে স্মার্ট শহরগুলোর একটা বার্ষিক তালিকা তৈরি করে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ম্যানেজমেন্ট ডেভেলপমেন্ট (আইএমডি)।
চলতি বছরে পঞ্চম বর্ষে পড়ল এই উদ্যোগ। ২০২৪ সালের তালিকা তৈরির জন্য ১৪২টি শহরের বাসিন্দাদের কাছে তাদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা, গতিশীলতা, বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ও সুশাসন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। তার ওপর ভিত্তি করে পাওয়া নম্বর অনুযায়ী ‘র্যাংকিং’ হয়েছে।
‘স্মার্ট সিটি সূচক ২০২৪’ অনুযায়ী, বিশ্বের সেরা ১০টি স্মার্ট শহর হলো জুরিখ, অসলো, ক্যানবেরা, জেনেভা, সিঙ্গাপুর, কোপেনহেগেন, লুসান, লন্ডন, হেলসিংকি ও আবুধাবি। কিন্তু ঠিক কী কারণে এই শহরগুলো ‘স্মার্ট’? আর তার কোন বৈশিষ্ট্যই বা বাসিন্দাদের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ‘স্মার্ট সিটি ইনডেক্স ২০২৪’-এর তালিকায় থাকা পাঁচটি শহরের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলেছিল বিবিসি।
ক্যানবেরা
‘স্মার্ট সিটি ইনডেক্স ২০২৪’-এ তিন নম্বরে রয়েছে অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরা।
ব্র্যান্ড রেবেলিয়ন নামের কর্মশক্তি বিষয়ক পরামর্শদাতা সংস্থার সহপ্রতিষ্ঠাতা ডেভিড ক্যাম্পবেল ক্যানবেরার আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছেন। তার কথায়, ‘শহরের স্মার্ট সিটি উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে স্মার্ট আলো, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম, যা ক্যানবেরার বিভিন্ন পরিষেবার দক্ষতা ও স্থায়িত্বকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করে তুলেছে৷’ একই সঙ্গে জানিয়েছেন সেখানকার সহনাগরিকদের মধ্যে যে আন্তরিক বন্ধন রয়েছে তার কথাও।
ক্যাম্পবেল আরো বলেছেন, ‘পারস্পরিক এই বন্ধন খুবই মজবুত এবং মানুষের মধ্যে একে অপরকে সাহায্য করার বা পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছাও প্রবল।
এই শহর সাসটেইনেবিলিটি বা স্থায়িত্বকে ভীষণভাবে গুরত্ব দেয় এবং সেই কারণেই প্রকৃতির সান্নিধ্যে থাকার বিষয়ে জোর দেওয়া হয় জানিয়ে তিনি আরো বলেন, ‘পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও পুনঃবিকিরণযোগ্য উদ্যোগের দিক থেকে ক্যানবেরা উন্নত। ২০৪৫ সালের মধ্যে নেট জিরো এমিশন (নেট শূন্য নিঃসরণ) বাস্তবায়িত করার উচ্চাভিলাষ যে ক্যানবেরার রয়েছে তা এই অঞ্চলজুড়ে চলমান বিদ্যুতায়ন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎস ব্যবহার থেকে স্পষ্ট হয়ে যায়।’
শহরকে বাসযোগ্য করে তুলতে যেমন প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়, তেমনই স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠাতা ও অন্য ব্যবসায়ীদের কাছে আরো আকর্ষণীয় করে তোলার কথাও মাথায় রাখা হয়। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার ক্যানবেরায় সৃজনশীল উদ্ভাবনী পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রে সাহায্যও করে। শক্তিশালী উচ্চগতির ইন্টারনেট, সামগ্রিক সংযোগ ‘রিমোট ওয়ার্ক’-এর মতো বিষয়গুলোকে আরো সহজ ও উন্নত করে তুলেছে। একই সঙ্গে উদ্ভাবনকেন্দ্র ও ক্যানবেরা ইনোভেশন নেটওয়ার্কের মতো কো-ওয়ার্কিং স্পেসে (এক ছাদের তলায় বিভিন্ন সংস্থার অফিস রয়েছে এমন ভবন) প্রযুক্তিগত বিকাশ ও বাণিজ্যিক পরিবেশ তৈরির ক্ষেত্রেও সাহায্য করেছে।
সিঙ্গাপুর
চলতি বছরে ‘স্মার্ট সিটি ইনডেক্সে’ পঞ্চম স্থানে থাকা সিঙ্গাপুর গতবারের তুলনায় দুই ধাপ এগিয়েছে। এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে সেখানকার সুরক্ষা ব্যবস্থা (সিসিটিভি দিয়ে মোড়া), যা স্কুল ও ট্রাফিক ব্যবস্থার পর্যবেক্ষণকে সহজ করে তোলে। একই সঙ্গে অনলাইন রিপোর্টিং ও নথি সংক্রান্ত কাজে দ্রুততাও এনেছে, যা সরকারি আমলাতন্ত্রের মতো বিষয়ের মোকাবেলা করতে সাহায্য করে।
ফিরদৌস সায়াজওয়ানি বলেন, ‘ওপেন ডেটা ও যোগাযোগহীন পেমেন্ট প্রযুক্তির কৌশলগত ব্যবহারের ফলে সিঙ্গাপুরের গণপরিবহনব্যবস্থা ব্যাপকভাবে উন্নত হয়েছে। একই সঙ্গে এখানকার বাসিন্দা আর পর্যটক উভয় পক্ষের জন্যই যাতায়াতব্যবস্থাকে সহজ করে তুলেছে।’
সিঙ্গাপুরের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা সায়াজওয়ানি আরো জানান, সরকারি ও বেসরকারি দুই সংস্থাই ট্রাফিকের ধরন, বাস ও ট্রেনের সময়সূচি এবং স্টেশনে মানুষের ভিড় সম্পর্কে বিস্তৃত তথ্য প্রকাশ করে। এই তথ্য অ্যাপ বিকাশকারী সংস্থা ও নগর পরিকল্পনাবিদরা ব্যবহার করে থাকেন যাতায়াতসংক্রান্ত সমস্যার সমাধান, যাত্রীদের ভ্রমণের রুট অনুকূল করা, সময় সাশ্রয় এবং সর্বোপরি শহরের যানজট হ্রাস করতে।
লুসান
চলতি বছরে সেরা স্মাৰ্ট শহরের তালিকায় শীর্ষ দশের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে তিনটি সুইস শহর। ১ নম্বরে জুরিখ এবং ৪ নম্বরে রয়েছে জেনেভা। কিন্তু এদের তুলনায় কম যায় না ছোট শহর লুসান। ‘স্মার্ট সিটি ইনডেক্সে’ সপ্তম স্থানে থাকলেও নিজের আকারের তুলনায় বেশ ভালো ফল করেছে এই শহর, যার জনসংখ্যা দেড় লাখের কাছাকাছি। বাসিন্দাদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা শহরের ভিতকে আরো মজবুত করেছে।
লুসান পর্যটনের জনসংযোগ ব্যবস্থাপক অলিভিয়া বোসহার্ট বলেন, ‘আমি লুসানে থাকতে ভালোবাসি। কারণ এই ছোট শহরে সেই সব সুযোগ-সুবিধা রয়েছে, যা একটা বড় শহরে থাকে। এখানে সব কিছুই খুব কাছাকাছি, হেঁটে যাওয়া যায়। স্টেশন থেকে লেক জেনেভা যেতে মাত্র ১৫ মিনিট সময় লাগে। আর শহরের কেন্দ্রে যেতেও লাগে ১৫ মিনিট।’
প্রকৃতির কাছাকাছি থাকাকে গুরুত্ব দেয় এই শহর। পার্ক, বাগান ও অন্যান্য সবুজে মোড়া জায়গায় প্রচুর বিনিয়োগ করা হয়। মোট ৩৬০ হেক্টর সবুজে ঢাকা জায়গা রয়েছে লুসানে এবং প্রতিবছর এক হাজার ৪০০টিরও বেশি নতুন গাছ লাগানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে।
সানের কমিউনিকেশন ডিরেক্টর আলেক্সান বোর্নোজ বলেন, ‘এ ছাড়া এই শহর দীর্ষমেয়াদি উপায়ে ডিজিটাল উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই শহর ডিজিটাল প্রভাব কমাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং প্রশাসনের ডিজিটাল রূপান্তরকে সমর্থন করে।’ বাসিন্দাদের ও পযটকদের ডিজিটাল পরিষেবা দেওয়ার প্রচেষ্টার দিকেও ইঙ্গিত করেছেন তিনি। তার কথায়, ‘লুসানে ঘোরাঘুরি ও বসবাসের জন্য ব্যাবহারিক তথ্য খুঁজে পেতে একটা মোবাইল অ্যাপ আছে। বাসিন্দাদের জন্য রেজিস্ট্রেশন এবং সংরক্ষণ, পরিবহন তথ্য ও ভ্রমণ, শহরের ওয়াইন বিক্রিসহ আরো অনেক ক্ষেত্রেই অনলাইন পরিষেবা আছে।’
লন্ডন
এই তালিকায় ৮ নম্বরে আছে লন্ডন। গত বছরের তুলনায় দুই ধাপ নিচে নেমে গেলেও লন্ডন ভালো ফল করেছে তার অনলাইন পরিষেবা, বিশেষত পরিবহন বুক করা ও সহজেই ব্যবহারযোগ্য ওয়াই-ফাইয়ের কারণে।
উইনিং বিজনেস ইউকে লিমিটেড সংস্থার এমা অর বলেন, ‘লন্ডনে পরিবহনের জন্য যেমন টিউব, বাস, নৌকা রয়েছে তেমনই রয়েছে বাইক ও স্কুটারও। একই সঙ্গে রেস্তোরাঁ, পাব, নাইট লাইফ, কনসার্ট এবং আরো অনেক কিছু আছে, যা সপ্তাহের প্রতিটা দিনকে আরো উপভোগযোগ্য করে তোলে।’ লন্ডনের ৩২টি বরোতে ইলেকট্রনিক ভেহিকল বা ইভি চার্জিংয়ের (বৈদ্যুতিক যানবাহনের চার্জ করা) অবকাঠামো নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। কয়েক বছর ধরে এই শহরকে সাসটেইনেবিলিটি অর্জন করার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য একাগ্রভাবে কাজ করতে দেখেছেন। তিনি আরো বলেন, ‘ভবনের নকশা তৈরি এবং এনার্জি হারভেস্টিং, এই দুই ক্ষেত্রেই শহরজুড়ে স্মার্ট গ্রিড, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে।’
সাসটেইনেবিলিটি অর্জন করতে এই শহর বৈদ্যুতিক যানবাহন ব্যবহারের দিকে জোর দেয়। এই উদ্যোগ শহরের আলট্রা লো এমিশন জোন নীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত, যার আওতায় গ্যাস নির্গমনকারী গাড়ির চেয়ে বৈদ্যুতিক গাড়ি চালানো কম ব্যয়বহুল করে তোলে।
আবুধাবি
সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি এই বছর রয়েছে ১০ নম্বরে। রেটিংয়ের দিক থেকে গতবারের তুলনায় তিন ধাপ এগিয়েছে আবুধাবি। সহজ যাতায়াতব্যবস্থা এবং অনলাইন বুকিং, শহরের দরিদ্রতম অঞ্চলেও উচ্চ নিকাশি ব্যবস্থা, স্কুলে ডিজিটাল দক্ষতা বাড়ানোর জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার কারণে আবুধাবি ভালো ফল করেছে। একই সঙ্গে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মানুষ এই শহরে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছেন বলেও জানিয়েছেন।
বাসিন্দাদের কাছে শহরের পরিবহন ব্যবস্থার স্মার্ট ও সুবিধাজনক বৈশিষ্ট্য বেশ উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া আবুধাবির বাসিন্দা ধনভিন শ্রীরাম বলেন, ‘শহরের যানবাহন চার্জিং পরিকাঠামো ও স্বায়ত্তশাসিত ড্রাইভিং এখানকার যাতায়াতব্যবস্থাকে মসৃণ ও দক্ষ করে তুলেছে।’
এআই টুল প্রম্পট ভাইবস নামের একটা সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা শ্রীরামের কথায়, ‘স্থলপথ, সমুদ্র, বিমান ও রেল পরিবহন যাতে নির্বিঘ্নে পরিচালিত হয় সে বিষয়টা নিশ্চিত করে ইন্টেলিজেন্ট মোবিলিটি সেন্টার। এই উন্নত ব্যবস্থা শুধু যানজটই কমায় না, পরিবেশের ওপর পরিবহনের নেতিবাচক প্রভাবও কমায়।’
সাসটেইনেবল উন্নয়ন মডেল হিসেবে নির্মিত মাসদার সিটির প্রসঙ্গ এনেছেন তিনি। আবুধাবির মধ্যেই রয়েছে এই অত্যাধুনিক কিন্তু পরিবেশবান্ধব অঞ্চল। তিনি বলেন, ‘এর (মাসদারের) নকশা আধুনিক প্রযুক্তি এবং ঐতিহ্যবাহী আরব স্থাপত্যের মিশেলে তৈরি। এমনকি গ্রীষ্মের ঝলসে যাওয়া মাসগুলোতেও প্রাকৃতিকভাবে ঠাণ্ডা পরিবেশ থাকে। ছাদে সৌর প্যানেলের ব্যাপক ব্যবহার সূর্যের শক্তিকে ব্যবহার করে, একে মধ্যপ্রাচ্যের বৃহত্তম ফোটোভোলটাইক স্থাপনার মধ্যে একটা করে তুলেছে।’