কয়েক বছর তৎপরতা মোটের ওপর কম থাকলেও সম্প্রতি নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সোমালিয়ার কুখ্যাত জলদস্যুরা। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার তারা বাংলাদেশি একটি জাহাজ ছিনতাই করে ২৩ জন নাবিককে জিম্মি করেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় লোহিত সাগরে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলা নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে সোমালি জলদস্যুরা ভারত মহাসাগরে আবারও তৎপর হয়েছে বলে মত বিশ্লেষকদের।
যেভাবে উত্থান
ইতালির ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ১৯৬০ সালে স্বাধীনতা পায় সোমালিয়া।
এতে ক্ষতিগ্রস্ত স্থানীয় জেলেদের একাংশ এক পর্যায়ে দস্যুবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে বলে মনে করা হয়। তাদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ বেশ কয়েকটি দেশ এই জলপথে সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। এতে আবার অনেকটাই থমকে যায় সোমালি জলদস্যুদের তৎপরতা।
সাম্প্রতিক তৎপরতা
ইদানীং সোমালি জলদস্যুদের উৎপাত আবারও বেড়েছে।
লাইবেরিয়ার জাহাজ উদ্ধারে সংশ্লিষ্ট মার্কিন নৌবাহিনীর ধারণা, আক্রমণকারীরা সম্ভবত সোমালিয়ার জলদস্যু ছিল। ডিসেম্বরে মাল্টার পতাকাবাহী একটি জাহাজ ছিনতাই করে এর ১৭ জন নাবিককে জিম্মি করে জলদস্যুরা। এখনো তাঁরা জিম্মি।
সামুদ্রিক অপরাধ মোকাবেলায় কাজ করা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরোর (আইএমবি) মতে, ছয় বছরের মধ্যে এটিই ছিল সোমালি জলদস্যুদের প্রথম সফল ছিনতাই।
গত জানুয়ারির এক সপ্তাহে তিনটি অভিযান চালিয়ে ১৯ জন জিম্মিকে উদ্ধার করে ভারতীয় নৌবাহিনী। তাদের ভাষ্য, জিম্মিরা সোমালি দস্যুদের হাতে বন্দি ছিলেন।
সবশেষ গত মঙ্গলবার মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাইয়ের দিকে যাওয়ার পথে সোমালি দস্যুদের কবলে পড়ে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ।
হুতি ঠেকাতে গিয়ে অরক্ষিত সোমালিয়া উপকূল
রয়্যাল ড্যানিশ ডিফেন্স কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ট্রোয়েলস বুরচাল হেনিংসেন জানান, ২০০৫ থেকে ২০১২ সালে এডেন উপসাগর অঞ্চলে ব্যাপকভাবে জলদস্যুতা বেড়ে গিয়েছিল। তখন আন্তর্জাতিক বাহিনী ওই জলসীমায় টহল জোরদার করে। কিন্তু সম্প্রতি ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা লোহিত সাগরে বেশ কিছু জাহাজে আক্রমণ করায় সেই দিকে মনোযোগ দিয়েছে পশ্চিমারা। আর এই সুযোগটাই নিয়েছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা।
ছিনতাইনির্ভর অর্থনীতি
সোমালিয়াসহ উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার কয়েকটি দেশের মানচিত্রের আকার একত্রে শিংয়ের মতো বলে এর নাম ‘হর্ন অব আফ্রিকা’। এই হর্ন অব আফ্রিকা হিসেবে পরিচিত অঞ্চলে ২০০৫ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত দস্যুদের অর্থ আদায়ের একটি হিসাব করেছে বিশ্বব্যাংক। সেই হিসাব অনুযায়ী, নাবিকদের জিম্মি করে ৩৫ থেকে ৪২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার আদায় করেছে দস্যুরা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংস্থা ওশান বিয়ন্ড পাইরেসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগরে দস্যুতার কারণে বছরে ৭০০ থেকে এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সোমালিয়ায় জলদস্যুতা এখন বিশাল বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রবাসী সোমালিরা এই খাতে বিনিয়োগ করে থাকেন। এমনকি সোমালিয়ার সেনাবাহিনী, সরকারের মন্ত্রী ও নেতা থেকে শুরু করে বড় বড় ব্যবসায়ীরা লুটের অর্থের ভাগ পেয়ে থাকেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে।
অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, জলদস্যুতায় তুলনামূলকভাবে বেশ ভালো আয় হওয়ায় তা সোমালিয়ার অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
আইওসির দাবি, সোমালিয়াভিত্তিক সশস্ত্র জঙ্গি গোষ্ঠী আল-শাবাব জাহাজ ছিনতাইয়ে মদদ দিচ্ছে। খবর রটেছে, আল-শাবাব ও জলদস্যুদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। এর আওতায় সশস্ত্র গোষ্ঠীটি জলদস্যুদের সুরক্ষা দেয়। বিনিময়ে আদায় করা মুক্তিপণের একটি বড় অংশ পায় তারা।
দস্যুরা কেন অপ্রতিরোধ্য
জলদস্যুদের কবল থেকে বাঁচতে জাহাজের মালিকদের দ্রুতগতিতে ভ্রমণের পরামর্শ দিয়ে থাকে আইএমবি। কিন্তু প্রায়ই রাতের আঁধারে হামলা চালায় দস্যুরা। তাই কিছু টের পাওয়ার আগেই জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় তারা। একবার তারা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। কারণ এতে জাহাজে থাকা জিম্মিদেরও হতাহতের শঙ্কা থাকে। এ ছাড়া গভীর সাগরে আটক জলদস্যুদের বিচার নিয়ে আইনি জটিলতার কারণে কখনো কখনো তাদের ছেড়ে দিতে হয়।
উত্তর-পূর্ব আফ্রিকায় জলদস্যুতা প্রতিরোধে নিয়োজিত সামরিক কর্তৃপক্ষ ইইউন্যাভ ফর আটালান্টা বলেছে, ওই অঞ্চলে ভারতীয় নৌবাহিনী ছাড়া জলদস্যুতা প্রতিরোধে সক্রিয় থাকা অন্য নৌবাহিনীগুলোর তৎপরতা কমে গেছে। এটাও দস্যুদের তৎপরতা বাড়ার কারণ।