প্রায় এক সপ্তাহের বিরামহীন বোমাবর্ষণের পর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার উত্তরের ১১ লাখ অধিবাসীকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলে চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। গতকাল শুক্রবার ইসরায়েলি বাহিনীর এই নির্দেশনাকে জাতিসংঘ ও বিশেষজ্ঞরা অসম্ভব বলে আখ্যা দিয়েছেন।

গাজাইসরায়েলি বাহিনী বিমান থেকে লিফলেট ফেলে দ্রুত এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ার পর প্রাণের ভয়ে অনেক ফিলিস্তিনি গতকাল দক্ষিণ দিকে সরে যেতে থাকে। তবে গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, গণহারে বাড়িঘর ছাড়া বলতে যা বোঝায় সে রকম কিছু গতকাল পর্যন্ত দেখা যায়নি।

 

 

এদিকে ইসরায়েলি বিমানবাহিনী গত রাতে বলেছে, গত ২৪ ঘণ্টায় জিম্মিদের অবস্থান চিহ্নিত ও ‘সন্ত্রাসীদের দমন করতে’ গাজার কিছু এলাকায় ইসরায়েলি পদাতিক ও গোলন্দাজ সেনা ‘স্থানীয় পর্যায়ে’ অভিযান চালিয়েছে।

জাতিসংঘ ও আরব লীগের উদ্বেগ

জাতিসংঘ বলেছে, কোনো মানবিক বিপর্যয় ছাড়া এত বেশি মানুষকে এই সময়ের মধ্যে সরিয়ে নেওয়া বস্তুত অসম্ভব। ইসরায়েলি এই নির্দেশের নিন্দা করেছে আরব দেশগুলোর জোট আরব লীগ। সংস্থাটির প্রধান আহমেদ ঘেইত গতকাল বলেন, ‘ইসরায়েল যেভাবে জোর করে গাজাবাসীকে স্থানান্তর করছে, তা অপরাধ।

 
’ 

 

ইসরায়েলের অব্যাহত বিমান হামলার পাশাপাশি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পানির অভাবে গাজাবাসীর জীবন এরই মধ্যে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। পুরো গাজা উপত্যকা পরিণত হয়েছে মৃত্যুপুরীতে। এর মধ্যে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার মধ্যরাতের পর দেওয়া নতুন ইসরায়েলি নির্দেশে মানুষ দিশাহারা হয়ে পড়ে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে বলা হয়, ‘গাজার বেসামরিক মানুষ, আপনারা নিজের নিরাপত্তা নিয়ে দক্ষিণে সরে যান।

 

 

আপনাদের এবং আপনাদের পরিবারকে হামাসের সন্ত্রাসীদের হাত থেকে দূরে রাখুন, যারা কিনা আপনাদের মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।’
উত্তর গাজা থেকে পালাচ্ছে ফিলিস্তিনিরা

ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর নির্দেশনার পর উত্তরের বহু মানুষ দক্ষিণ গাজার দিকে বিভিন্ন ধরনের যানে এমনকি হেঁটে রওনা হয়। ইসরায়েল সীমান্ত লাগোয়া উত্তরই শুধু নয়, মধ্য গাজার বাসিন্দারাও হামলার ভয়ে ছুটছে দক্ষিণের দিকে।

উপত্যকার গাজা সিটির বাসিন্দা ফারাহ আবো সেদো বলেন, ‘আমরা কোথায় যাব? এটি খুব ছোট একটি শহর। যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই।

 
আমরা জীবন বাঁচাতে চেষ্টা করছি। প্রতি রাতে নির্দয়ভাবে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে।’

 

গাজার খান ইউনুস এলাকায় জাতিসংঘের একটি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে কর্মরত জামিলেহ আবু জানুনা জানান, জাতিসংঘের গাড়িতে চেপে তিনি উত্তরাঞ্চল ছাড়ার সময় তিনবার বোমাবর্ষণ হতে দেখেন। পরিস্থিতি অবর্ণনীয়।

এক বিবৃতিতে রেড ক্রিসেন্ট অভিযোগ করেছে, মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালানো প্রতিষ্ঠানগুলো গাজার বিপন্ন মানুষের কাছে সহায়তা পৌঁছে দিতে পারছে না।

দ্বিতীয় নাকবার হুঁশিয়ারি আব্বাসের

ইসরায়েল গণহারে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেওয়ার পর ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ফিলিস্তিনি জনগণ দ্বিতীয় ‘নাকবা’র (বিপর্যয়) মুখে।

উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালে তৎকালীন ফিলিস্তিনে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর গণহারে ফিলিস্তিনিরা বাস্তুচ্যুত হয়। সেই ঘটনাকে ফিলিস্তিনিরা নাকবা হিসেবে স্মরণ করে। আরবি শব্দ নাকবা অর্থ ‘বিপর্যয়’।

প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস ফিলিস্তিনির নেতৃত্বের আরেক অংশ পশ্চিম তীর নিয়ন্ত্রণকারী শাসক দল ফাতাহর শীর্ষ নেতা। ১৯৪৮ সালের নাকবায় সাত লাখ ৬০ হাজার ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুত হয়। এবার ১১ লাখেরও বেশি ফিলিস্তিনি একই রকম পরিস্থিতির মুখে।

যুদ্ধবিরতির চেষ্টা করছে কাতার

সাত দিন ধরে চলা সংঘাত নিরসনের চেষ্টার কথা জানিয়েছে কাতার। কাতারের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মেদ বিন আব্দুল রাহমান আল থানি বলেন, কাতার যুদ্ধবিরতির জন্য মধ্যস্থতা চালাতে চায়। 

রাজধানী দোহায় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেনের সঙ্গে সাক্ষাতের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাতার কূটনীতিক উপায়ে যুদ্ধ বন্ধে অগ্রাধিকার দেয়, জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে কথা বলতে চায় এবং এ অঞ্চলের সংঘাত রুখতে কাজ করে যেতে চায়।

অ্যান্টনি ব্লিনকেন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র গাজায় ‘নিরাপদ এলাকা’ প্রতিষ্ঠার জন্য ইসরায়েল ও শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করছে। এ ছাড়া তিনি ইসরায়েলকে গাজায় বেসামরিক প্রাণহানি এড়াতে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।

এর আগে গতকাল ইসরায়েল সফরে এসে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিনও তাঁদের সমর্থনের বার্তা দেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্লিনকেনের পরদিন সংহতি জানাতে ইসরায়েলে যান অস্টিন।

ফিলিস্তিনি পক্ষে মৃত্যু প্রায় ১৮০০

গাজায় হতাহতের চিত্র তুলে ধরে হামাস প্রশাসনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গতকাল স্থানীয় সময় সন্ধ্যা পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা অন্তত এক হাজার ৭৯৯। অন্যদিকে পশ্চিম তীরে বিক্ষোভের সময় ইসরায়েলি সেনাদের গুলিতে ১১ জন নিহত হয়েছে। গুরুতর আহতদের মৃত্যুর কারণে হামাসের শনিবারের হামলায় ইসরায়েলি পক্ষে নিহতের সংখ্যা এক হাজার ৩০০ ছাড়িয়েছে।