৬ বছর ধরে বাংলাদেশ ফুটবলের সিংহাসন তাঁর দখলে। যদিও তাঁর সময়ে তেমন কোনো উন্নতি হয়নি বলে প্রতিনিয়ত সমালোচিতই হয়ে এসেছেন তিনি। তবু বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি পদে কাজী সালাউদ্দিন-এর পঞ্চমবারের মতো নির্বাচন করার ঘোষণা দেশের ক্রীড়াঙ্গনজুড়েই জন্ম দিয়েছে বিস্ময়ের। সাক্ষাৎকারে অবশ্য নিজের অবস্থানের পক্ষে নানা যুক্তিই তুলে ধরেছেন তিনি
প্রশ্ন : আবারও নির্বাচন করবেন বলেছেন। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটা আরো বেশি চ্যালেঞ্জিং নয় কি আপনার জন্য?
কাজী সালাউদ্দিন : আমার জন্য সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমি যে ২০০৮ সালে নির্বাচন করেছি প্রথমবার, তখন তো গোটা আওয়ামী লীগ আমার বিরুদ্ধে ছিল। সেনাশাসিত সরকার তখন।
প্রশ্ন : তার পরও পরবর্তী সময়ে যাঁদের নিয়ে বেশি সময় ছিলেন, তাঁদের অন্যতম আব্দুস সালাম মুর্শেদী তো এর মধ্যেই পদত্যাগ করেছেন, কাজী নাবিল আহমেদও প্রকাশ্যে নেই। নির্বাচনে তো একটা প্যানেল গোছানোর ব্যাপার থাকে, সেটি আপনার জন্য এখন কঠিন নয় কি?
সালাউদ্দিন : কঠিন, তাতে অসুবিধা কোথায়? নির্বাচন করে না হয় হারব, অসুবিধা তো নেই।
প্রশ্ন : তো এই ধরনের কথাবার্তার কারণে জেদ থেকেই কি আপনি বলছেন নির্বাচন করবেন, নাকি সত্যি সত্যিই ভাবছেন এটা সম্ভব?
সালাউদ্দিন : আমি সত্যি সত্যিই ভাবছি। আপনারা একটা জিনিস ভুলে যাবেন না, আমি কিন্তু একাত্তরে যুদ্ধ করেছি। আমি কিন্তু স্বাধীন বাংলার খেলোয়াড়। আমি কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নই।
প্রশ্ন : কিন্তু আপনার বিরুদ্ধে যাঁরা বলছেন, এই মুহূর্তে যাঁরা পদত্যাগের আন্দোলন করছেন তাঁরা নন, তার আগে আশরাফ উদ্দিন আহমেদ চুন্নু, আব্দুল গাফফারের মতো সাবেক খেলোয়াড়রা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন...
সালাউদ্দিন : আপনি যাঁদের নাম বলছেন, এঁরা সবাই নির্বাচন করেছেন। কেউ পাঁচ ভোট পেয়েছেন, কেউ সাত ভোট...ওঁদের ওপর এত আস্থা মানুষের! কিন্তু তাঁরা টিভির পর্দা দখল করে রেখেছেন, মাঠে উনাদের দেখি না।
প্রশ্ন : কিন্তু উনারা এমন অভিযোগও করেছেন যে কাউন্সিলরশিপ বাছাইয়ের মাধ্যমে এই সময়ে নির্বাচনকে প্রভাবিত করা হয়েছে...
সালাউদ্দিন : এটা একদম বাজে কথা। আপনি কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। আমরা কোনো কাউন্সিলরশিপের ব্যাপারে কোনোভাবে কিছু করিনি। আর যার যার সংস্থার কাউন্সিলর তো তারাই নির্বাচন করে। এখানে তো ফেডারেশনের হাতে কিছু নেই। ওখান থেকেই নাম আসে। কিছু কিছু কাউন্সিলর তো আছেন যাঁরা ২৪ ঘণ্টা আমাদের গালাগাল করেন, এঁরা এর সঙ্গে যোগ দেন তো ওর সঙ্গে যোগ দেন। ওঁরা তো কাউন্সিলর হচ্ছেন।
প্রশ্ন : আপনি এবারের নির্বাচনের তারিখটা যখন ঘোষণা করেছেন, তখন আপনার সঙ্গে যাঁরা ছিলেন বা যে পরিস্থিতি ছিল, এখন তো তা থেকে ভিন্ন। সেখানে আপনি কিভাবে নির্বাচনের এই পুরো ব্যাপারটা গোছাতে পারবেন বলে মনে করছেন?
সালাউদ্দিন : কে থাকবে, কে না থাকবে এটা তো তার ব্যক্তিগত বিষয়। ক্রীড়া সংগঠক তো দেশে কম না। আমি তো কম চিনি না, আমি ৫০ বছর ধরে এই অঙ্গনে আছি। আমি দেখি কী করতে পারি। আর এত প্রশ্নের তো দরকারই নেই, আমাকে যদি পছন্দ না হয়, ভোট দেবেন না। আপনারা নিয়ে যান না নির্বাচন করে। কিন্তু নির্বাচন না করে তো সেটা পারবেন না। এই যে কথা বলছেন, আসলাম, চুন্নু...আমি যদি ছেড়েও বলি আসলাম সাহেব নিয়ে যান, চুন্নু সাহেব নিয়ে যান; উনারা তা পারবেন না। কারণ ফিফা আপনাকে (ফেডারেশনকে) নিষিদ্ধ করে দেবে। যত কথাই বলুন, আপনাকে নির্বাচনে আসতেই হবে ফিফার নিয়ম মেনে। আমি ২০০৮ সালে প্রথম নির্বাচনে এসেছি, কেন এসেছি...তার আগেও তো আসতে পারতাম। ২০০৮ সালে এসেছি, কারণ এখন যে বলছেন, বের করো, এটা তখন বলতে পারতেন না। তখন সেনা সরকার ছিল চেয়ারে। আর এখনো যদি আপনারা ভাবেন জিতবেন, তাহলে আসুন না, নির্বাচনে সমস্যা কোথায়? উনাদের বরং প্রশ্ন করুন না, তাঁরা কী করেছেন গত ১২ বছরে। কোন ক্লাবটাকে দাঁড় করিয়েছেন?
প্রশ্ন : সঙ্গী-সাথিদের অনেকে না থাকার পরও আপনি যে এই সময়ে নির্বাচন করার আত্মবিশ্বাস পাচ্ছেন, সেই বিশ্বাস আসতে পারে যদি নিজেকে আপনি খুব সফল মনে করেন বাফুফে সভাপতি হিসেবে। আসলেও কি তাই?
সালাউদ্দিন : অবশ্যই। আগে তো ফুটবল লিগই ছিল না। সেই লিগটা আমি ধারাবাহিকভাবে ১৫ বছর করে গেছি। আজ খেলোয়াড়রা গাড়ি চালায়, বিশ্বকাপ বাছাই খেলে, কাতারে গিয়ে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প করে, সৌদি আরবে যায়, ফাইভ স্টার হোটেলে থাকে। মেয়েদের কোনো দল ছিল না। সেই দলকে আমি দক্ষিণ এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ন বানিয়েছি। মেয়েদের আমি জাপান, কোরিয়া থেকে শুরু করে কোনো জায়গা বাদ দিইনি, ওদের খেলিয়েছি। এই সব আমি নিজের চেষ্টায় করেছি। তাহলে কেন আমি নিজেকে সফল দাবি করব না? আমি তো নিজে ফুটবল খেলেছি। ১৩ বছর জাতীয় দলে খেলেছি, আমাদের অনুশীলন করানো হয়েছে মোহাম্মদপুরে শারীরিক শিক্ষা কলেজ মাঠে। ওই ধরনের মাঠে আমাদের অনুশীলন করা হয়েছে, স্টেডিয়ামের ছাদে রাখা হয়েছে। কুমিল্লার কোটবাড়ীতে ক্যাম্প করতে হয়েছে, রাতের বেলা ড্রেনের পানি সেখানে রুমের মধ্যে ঢোকে। এখন তো ফুটবলাররা কাতারে যায়!
প্রশ্ন : তবু জাতীয় দলের মানের তো খুব একটা পরিবর্তন হয়নি।
সালাউদ্দিন : না, হয়নি। কিন্তু এখন তো আমরা ১০ গোল খাই না। আগে নিয়মিত সেটাই হতো। ১৯৭৬ সাল থেকে যদি চিন্তা করেন, ফল তো ও রকমই ছিল। আমার কোচিংয়েও বড় হার আছে, অস্বীকার করব না। কিন্তু আজ তো লড়াই করে ছেলেরা, ফুটবল খেলে। আমি লিগ নিয়মিত করে দিয়েছি। দেখেন, চার বছর ধরে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম নেই, তাই বলে লিগও বন্ধ থাকেনি। কিছু কৃতিত্ব অন্তত আমাকে দিন।
প্রশ্ন : লিগ নিয়ে আপনি অনেক দিন থেকেই এ রকম কথা বলে আসছেন...।
সালাউদ্দিন : দেখুন, ফুটবল ফেডারেশনের দায়িত্ব হলো দুটি। একটি হলো লিগ চালানো আর দ্বিতীয়টি হলো জাতীয় দলের কোচিং স্টাফসহ অন্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা। আর কোনো দায়িত্ব নেই। এই যে ডেভেলপমেন্টের কথা বলেন, এটা পৃথিবীর কোনো ফেডারেশনই করে না। একাডেমি করাও ফেডারেশনের কাজ নয়। তবু আমি কমলাপুরে একটি করে দিয়েছি।