আমার স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থীরা প্রায়ই তাদের হতাশার কথা ব্যক্ত করে। অনেকেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমাকে অনুরোধ করে। কয়েক দিন আগে স্নাতকপড়ুয়া আমার এক ছাত্র কুশল বিনিময়ের লক্ষ্যে আমাকে ফোন করে তার হতাশা ব্যক্ত করতে গিয়ে একটি আবেগজড়িত অভিজ্ঞতা শেয়ার করল। সে জানাল, তার মা-বাবা হতাশ হয়ে ইদানীং বলছেন, কেন যে তাঁরা ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন! কেন তাকে ছোটবেলা থেকেই কোনো কাজে লাগিয়ে দেননি! তাঁরা মনে করেন, যদি পড়াশোনা না করিয়ে কোনো কাজে লাগিয়ে দিতেন, তাহলে হয়তো উচ্চশিক্ষিত সন্তানের এই বোঝা দীর্ঘ সময় ধরে টানতে হতো না। এমন অভিজ্ঞতা খুঁজতে গেলে অসংখ্য পাওয়া যাবে। ধরে নেওয়া যায়, এটিই নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের বাস্তব চিত্র। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মতামত দেখলে আমরা অনুভব করতে পারি, দেশে কর্মসংস্থানের হাহাকার কতটা ভয়াবহ!

এ প্রেক্ষাপটেই প্রস্তাবিত বাজেটে বিশেষত শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের  কর্মসংস্থান প্রসঙ্গটি কতটা গুরুত্ব পেয়েছে, তা খুঁজে দেখার ন্যায্যতা অনেক বেশি। কর্মসংস্থান নিয়ে অর্থমন্ত্রী প্রায়ই তাঁর পরিকল্পনার ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন। আমরা গণমাধ্যম থেকে এ বিষয়ে ধারণা পেয়ে থাকি। তিনি স্পষ্টতই বেশ কয়েকবার বলেছেন, বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্য সুযোগ-সুবিধা রাখার মানে কর্মসংস্থান সৃষ্টিরও বেশ সুযোগ তৈরি করা।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশের বর্তমান জনগোষ্ঠীর ৬২ শতাংশ কর্মক্ষম। আর জনসংখ্যার ২৮ শতাংশ তরুণ। অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা থেকে জানা যায়, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রস্তুতি হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যমাত্রা ২০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৩০ লাখ নির্ধারণ করা হয়েছে। দেশের কর্মক্ষম শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে অর্থনীতির গতি সঞ্চারের লক্ষ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৩৪৭ কোটি ১৯ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে তরুণ সমাজকে প্রস্তুত করতে বাজেটে গবেষণা, উদ্ভাবন ও উন্নয়নমূলক কাজে অতিরিক্ত ১০০ কোটি টাকা বিশেষ বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব হয়েছে। এ ছাড়া নারী ও শিশুবান্ধব কর্মস্থল তৈরিতে নানা উদ্যোগ আছে বাজেটে। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বরাদ্দ আরও বেশি হলে ভালো হতো। বিশেষ করে বাজেটের পরিকল্পনা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন এবং এর সুচিন্তিত প্রয়োগ নিয়ে শঙ্কা অনেকের মনেই রয়েছে। তার পরও তরুণদের যথাযথভাবে উজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সরকারের ইতিবাচক ভাবনাকে সাধুবাদ জানাতে হয়।

কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে না দেখলে বেকারদের আগামীর জীবন অনিশ্চয়তায় পড়তে পারে দীর্ঘ সময়ের জন্য। যেসব শিক্ষার্থী করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে শিক্ষাজীবন শেষ করেছিল, তাদের জীবন ভয়াবহ সংকটে পড়েছে। চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নির্দিষ্ট হওয়ায় তাদের হাতে খুব কম সময় রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংস্কার ও গবেষণা অনুবিভাগ প্রতি বছর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পরিসংখ্যানের ‘স্ট্যাটিসটিকস অব গভর্নমেন্ট সার্ভেন্টস’ শিরোনামে বই প্রকাশ করে। গত ১ জুন প্রকাশিত বইটিতে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে শূন্য পদের সংখ্যা ৪ লাখ ৮৯ হাজার ৯৭৬। ২০২২ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রশাসনে মোট অনুমোদিত ১৯ লাখ ১৫১টি পদের বিপরীতে কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন ১৩ লাখ ৯৬ হাজার ৮১৮ জন। এর আগের বছরও পদ ফাঁকা ছিল ৩ লাখ ৫৮ হাজার ১২৫টি।

তরুণ ও যুবসমাজ একটি দেশ বিনির্মাণের মূল কারিগর। আমাদের দেশের তরুণ ও যুবসমাজ তাদের মেধা ও মনন দিয়ে গড়ে তুলবে আগামী দিনের বাংলাদেশকে– এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাদের বিরাট একটা অংশই যদি বেকারত্বের জাঁতাকলে পিষ্ট থাকে, তবে তা কী করে সম্ভব?

অনেকেই আছে, যাদের চাকরিতে প্রবেশের বয়স আর বেশি দিন নেই। আয়-রোজগারের পথ বন্ধ থাকলে সমাজে যে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে, তা বলা বাহুল্য। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে তরুণ প্রজন্ম। সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকের উদ্যোগে তারুণ্য জরিপে জীবনের লক্ষ্য, ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থান নিয়ে তরুণদের উদ্বেগের বিষয়টি পরিষ্কার হয়েছে। ৭৪ দশমিক ৫ শতাংশ তরুণ মূলত ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান নিয়ে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা ও অনিশ্চয়তায় থাকে।

করোনা সংকটে দেশে কত লোক কাজ হারিয়েছে কিংবা কোন শ্রেণির মানুষ বেশি চাকরি হারিয়েছে– এ নিয়ে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত নেই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) কাছেও নেই হালনাগাদ তথ্য। পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত না থাকায় সুবিধাভোগী চিহ্নিত করে সঠিক উদ্যোগও নেওয়া সম্ভব হয়নি। তা ছাড়া আমাদের দেশে জাতীয় কোনো ডাটাবেজ এখনও তৈরি হয়নি। তথ্য-উপাত্তের ঘাটতির কারণে সঠিকভাবে নীতি প্রণয়নও সম্ভব হয় না।

কাজেই সার্বিকভাবে বলা যায়, কর্মসংস্থান এখন সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে বাজেট বরাদ্দ এবং এর ভিত্তিতে পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সুস্পষ্ট পরিকল্পনা দাঁড় করানো গুরুত্বপূর্ণ। প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক কর্মী কাজ হারিয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে স্থায়ীভাবে সংকট সমাধানের বিশেষ তাগিদ অনুভূত হচ্ছে। এবারের বাজেটে বিদ্যমান শ্রমবাজারের সংকট নিয়ে একটি কর্মসংস্থান কমিশন গঠনের পরিকল্পনা গ্রহণ করা যেতে পারে। ওই কমিশন চলমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের লক্ষ্যে কাজ করবে। পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি ঢেলে সাজানো এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম পুনরুজ্জীবিত করার সুযোগ সৃষ্টি হবে। বিশেষ করে তরুণদের স্বপ্নকে পুনরুজ্জীবিত করতে উদ্যোক্তা তৈরির ক্ষেত্র আরও বাড়ানোর লক্ষ্যে বাজেটে সুনির্দিষ্ট বরাদ্দের বিষয়টি ভাবনায় রাখা প্রয়োজন।

ড. সুলতান মাহমুদ রানা: অধ্যাপক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়